আমাদের বংশ পরিচয়
আমাদের পূর্বনিবাস টাঙ্গাইল, অধুনা বাংলাদেশে অবস্হিত| আমাদের সঙ্গে বিকেলে হাঁটেন এক ভদ্রলোক, 1994 সালে টাঙ্গাইলে ওঁদের বাড়ি দেখতে গিয়ে দেখেন সেখানে ধান চাষ হচ্ছে, বাড়ি নেই| আমাদের দেশের বাড়ির কি অবস্হা কে জানে! আমাদের বাড়িও তো টাঙ্গাইলে, সহদেবপুর গ্রামে, অবশ্য সহদেবপুরকে সবাই সদোপুর নামেই চেনে| বাড়িটি আমার প্রপিতামহ গোবিন্দ প্রসাদ নিয়োগী টাঙ্গাইলে সহদেবপুরে তৈরি করেন, আনুমানিক দেড়শো বছর আগে| বাড়ির পাশ দিয়ে শীর্ণ নদী লাঙ্গুলিয়া বয়ে চলেছে| গোবিন্দপ্রসাদের পিতার নাম চণ্ডীপ্রসাদ| গোবিন্দ রাম ও রাম রূদ্র রা হলেন চণ্ডীপ্রসাদের পিতা ও পিতামহ|
খুব ছোট বয়সে, বোধ হয় তিন/চার বছর বয়সে, আমি বাবা মাদের সঙ্গে পুজোর সময় ঐ বাড়িতে গিয়েছিলাম| বাড়িটি একটি বিরাট U-আকৃতির দোতলা দালান বাড়ি| সামনের দিকে প্রশস্ত সুদীর্ঘ বারান্দা| ঐ বারান্দাতেই দুর্গাপুজো ও অন্যান্য পুজো হত| আমরা দোতলায় ছিলাম, সম্ভবত 1939 বা 1940 সালে| তখনই বাড়িটির ভগ্নদশা| দেয়াল থেকে ভিতরে ও বাইরের দিকে বটগাছ বেরিয়েছে| ঘরের ভিতরে গোখরা সাপ ছিল,-শুনেছি বাস্তু সাপ, তাদের মারা হোত না| আমাদের গ্রামের থানা ছিল টেরকি(কালিহাতি)তে| যাতায়াতের রাস্তায় পোড়াবাড়ি, এলাসিন পড়ত| পোড়াবাড়ির চমচম খুব বিখ্যাত ছিল|
আমরা বৈদ্য, দ্রুহি সেন, শক্ত্রি গোত্র| দ্রুহি বা ধোই রাজা বল্লাল সেনের সভাকবি ছিলেন, (1184- 1204 A.D.)|এবং কৌলিন্য লাভ করেন| পবনদূত কাব্য তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টি| কথিত আছে আমাদের পূর্বপুরূষ বর্ধমান জেলার কালনায় বসবাস করতেন| বঙ্গে বর্গি আক্রমণের সময় এদের এক গোষ্ঠি পূর্ব দিকে গমন করেন এবং শান্তিপুর গুপ্তিপাড়া অঞ্চলে বসতি স্হাপন করেন| এদেরই আর এক গোষ্ঠি পূর্ববঙ্গে যান ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে বসবাস সুরু করেন| ত্রিভঙ্গ সেনের “বৈদ্যকুলপঞ্জিকা” পুস্তকে নাকি আমাদের বংশের বিবরণ আছে এবং আমার ঠাকুর্দা ও তার ভাইদের সম্বন্ধে উল্লেখ রয়েছে| নবাবী আমলে আমরা নিয়োগী উপাধি লাভ করি| অনেক বৈদ্যরা নিজেদের উপধি “সেনগুপ্ত” লিখে থাকেন; ঠাকু্র্দার এতে আপত্তি ছিল কারন “গুপ্ত” বৈশ্যদের উপাধি| তিনি তৎপরিবর্তে “সেনশর্মা” লিখতেন| আজও বিবাহ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে আমরা আমাদের উপাধি “সেনশর্মা” লিখি|
আমার প্রপিতামহ গোবিন্দ প্রসাদ নিয়োগী সুপ্রতিষ্ঠিত উকিল ছিলেন| জামালপুর(সিংজানি ) আদালতে প্র্যাকটিস করতেন| তিনি প্রভূত সুনাম অর্জন করেন ও Govt. Pleader হন| তিনি Municipality র Chairman হয়েছিলেন| স্ত্রী করুণাময়ী(দ্রাক্ষাময়ী) ও তিনি নিজে কালিসাধক ছিলেন| করুণাময়ী দেবী নিরক্ষর হয়েও মুখে মুখে কবিতা ও গান রচনা করতেন এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে যাকে কাছে পেতেন তাকে দিয়ে এই সব কবিতা বা গান লিখিয়ে রাখতেন| তাঁর রচিত কয়েকশো কবিতা বা মালসা গান কনিষ্ঠ পুত্র অবনীপ্রসাদ পরবর্তীকালে “কালিকাবিলাস” নামে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন| সেকালে তাঁর নাম চারপাশের অনেকেই জানতেন| তাঁর জীবনী “বঙ্গীয় কবি” নামক একটি তৎকালীন পুস্তকে প্রকাশিত হয়| তাঁর জন্ম ১২৪৩ বঙ্গাব্দে ও মৃত্যু ১৩০৮ সালে| করুনাময়ী দেবীকে তারা “প্রথম বাঙ্গালী মহিলা কবির” সম্মান দেন| গোবিন্দপ্রসাদ ও করুণাময়ীর পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়ে ছিল| ছেলেরা সবাই উচ্চশিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন| “রত্নগর্ভা” বলে মহিলামহলে করনাময়ীর নাম ছিল| মেয়েদের কাছেপিঠে টাঙ্গাইলে বিয়ে হয়| এঁদের মধ্যে একজন হলেন বিজয়লহ্মী| তাঁর পুত্র, প্রখ্যাত গান্ধিবাদী নেতা সতীশ দাশগুপ্ত “ খাদি-প্রতিষ্ঠানের” প্রতিষ্ঠাতা| অন্য আরেক মেয়ে, সম্ভবত ভবতারিনীর কন্যার নাম, বাবার মুখে শুনেছি ননীদি, রংপুরে(অধুনা বাংলাদেশে) থাকতেন| এঁরই পুত্র গোপাল চন্দ্র সেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যাকে কর্মজীবন থেকে অবসর নেবার দিন, ১৯৭০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর, বাড়ির সামনে নকসালরা পেটে ছুরি মেরে হত্যা করে| যেদিন এঘটনা ঘটে, সেদিন শুক্রবার, ঘটনা ঘটার একটু আগে, বিকেল পৌনে ছ’টা নাগাদ, সাউথ রোড, সন্তোষপুরের বাড়ি থেকে আমি অন্য শুক্রবারের মত J.U. তে M.Sc. Numerical Analysis এর Theory and Practical, evening class নিতে যাই ও রাত ৯টায় ক্লাস শেষ করে ঐ একই রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসি| কোন কিছু চোখে পড়েনি| পরের দিন খবর পেলাম এই নৃশংস হত্যাকান্ডের|
গোবিন্দপ্রসাদ ও করুণাময়ীর পাঁচ ছেলেরা হলেন: i)রামপ্রসাদ, আমাদের পিতামহ, হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার, (জন্ম আনুমানিক 1860, মৃত্যু 1934), ii)রজনীপ্রসাদ, M.A. ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট,iii)ভবানীপ্রসাদ, B.A. B.C.S. iv)নলিনীপ্রসাদ, সিভিল সার্জেন, ধুবরি ও কনিষ্ঠ v)অবনীপ্রসাদ, ডিস্ট্রিক্ট জজ| এঁরা প্রত্যেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বৈদ্য সমাজে সুপরিচিত ছিলেন| রজনীপ্রসাদ ও ভবানীপ্রসাদ প্রেসিডেন্সী কলেজের সেরাছাত্র, ডবল অনার্স সহ B.A.পাস করেন| রজনীপ্রসাদের পুত্র জে.পি.নিয়োগী ভারতবর্ষে Economics চর্চার পথিকৃৎ|
ভবানীপ্রসাদ I.C.S. পড়ার জন্য বিলেত যাবার বৃত্তি লাভ করেন| বিলেত গেলে ছেলের জাত যাবে, তাই মার প্রবল আপত্তি ছিল| তৎসত্ত্বেও বিলেত যাবার প্রস্তুতি চলছিল| জামালপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে ট্রেন ছাড়ার সময় প্ল্যাটফর্মে মাকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে দেখেন| তৎক্ষণাৎ চেন টেনে ট্রেন থেকে নেমে পড়েন এবং বলেন, মাকে এত বড় দুঃখ দিয়ে আমার ICS হবার দরকার নেই| ঠাকুর্দার ভাইদের মধ্যে আমি, বাবার সঙ্গে ১৯৪৮ সালে, ঢাকায় টিকাটুলিতে নিজ বাড়িতে ভবানীপ্রসাদকে দেখেছি এবং ১৯৫০ সালে, বালিগঞ্জ দেশপ্রিয় পার্ক রোডের নিজ বাড়িতে অবনীপ্রসাদকে দেখেছি| ভবানীপ্রসাদের শরীর ভাল ছিল না, শয্যাগত ছিলেন| এর অল্প কিছুদিন পরে আমরা ময়মনসিং ফিরে এসেছি| একদিন সকালে বাবা মাকে বললেন, একটু আগে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখলাম,-কাকা আমাকে দেখা দিয়ে বললেন, “চললাম রে খোকা(বাবার ডাক নাম)|” মা বললেন স্বপ্ন স্বপ্নই, তাই নিয়ে মন খারাপ কোরো না| এর কয়দিন পরেই পোষ্টকার্ডে কাকার মৃত্যু সংবাদ এল| বাবা যেদিন যে সময়ে স্বপ্ন দেখেন ঠিক সেই সময়ে তিনি দেহত্যাগ করেন|
আমার বাবা সুরেন্দ্রপ্রসাদ হলেন রামপ্রসাদের ছোট ছেলে| রামপ্রসাদ F.A. পাস করার পর কলকাতায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা-বিদ্যা শিক্ষা করেন| কিন্তু এক বা দুই বছর পড়ার পর পড়া ছেড়ে দিয়ে দেশে অসুস্হ পিতার সেবার জন্য গ্রামের বাড়িতে চলে যান এবং বাড়িতে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন| হিন্দুধর্মশাস্ত্রে তার অগাধ পান্ডিত্য ছিল যা বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করে| ত্রিভঙ্গ সেন রচিত “বৈদ্য কুলপঞ্জিকা” পুস্তকে কথিত আছে, শাস্ত্রীয় মীমাংসার জন্য চারপাশের গ্রামের তো বটেই এমনকি দূর দূরান্তের ব্রাহ্মণ পন্ডিতরা ও ওঁর কাছে আসতেন| সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হবেন বলে তিনি দুবার কাশী যান, কিন্তু নানাকারনে সন্ন্যাস গ্রহণ হয়ে ওঠেনি| কাকাদের বাড়িতে থেকে আমার বাবা পড়াশুনা করেছেন| বাবারা অনেক ভাইবোন ছিলেন কিন্তু প্রপ্তবয়স্ক হবার আগেই বেশিরভাগ ভাই বোন মারা যান| বড় ভাই যতীন্দ্রপ্রসাদ F.A. পাস করে রেলে চাকরি করতেন| কর্মরত অবস্হায়, সম্ভবত চট্টগ্রামে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান, বোধ হয় ১৯৪০ এর আগে| তাঁর এক মেয়ে পদ্মা, দুই ছেলে ননী(পরেশ)ও কানাই(নরেশ)| ননীদা নড়ালে আমাদের বাড়িতে থেকে কলেজে পড়তেন| কানাইদার ছেলে ব্যাঙ্কে কাজ করত, বাড়ি করেছে ঢাকুরিয়া বাস স্টপের কাছে|
বাবার মেজ দাদা ভূপেন্দ্রপসাদ, জামালপুরে ওকালতি করতেন| পরে এপারে এসে গুড়দহ কলোনিতে বাড়ি করেন| আমার পিসিদের মধ্যে দুজনকে আমি দেখেছি| বড় জনের টাঙ্গাইলেই বিয়ে হয়, আর ছোটজন বাবার ছোট, নাম দুগি| তাঁর ছেলেরা ঢাকুরিয়া স্টেশন রোডে বাড়ি করেন| আমার ঠাকুমাকেও আমি ছোটবেলায় দেখেছি, আমাদের ময়মনসিং এর কলেজ রোডের বাড়িতে এসে কিছুদিন ছিলেন| নাম ছিল ভগবতী| বড় পিসি ও আমাদের বাড়ি এসেছেন| তাঁর কথাবার্তা হাবভাব একেবারে ঠাকুমার মত ছিল| ঠাকুর্দাকে আমি দেখিনি,-আমার জন্মের পরের বছর মারা যান| মার কাছে শুনেছি তিনি প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন| ছোট ভাইরা সব বড় বড় চাকরি করতেন, কিন্তু ওঁর সামনে মুখ তুলে কথা বলতে পারতেন না| তিনি কোন কথা বললে বা আদেশ দিলে তার অন্যথা হোত না| শেষ বয়সে সাধন-ভজন নিয়েই সময় কাটাতেন| তিনি অত্যন্ত নিয়মানুবর্তী ছিলেন এবং শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত বলে খ্যাতি ছিল|
এইবার আমার বাবা সম্বন্ধে বলি| সুপুরূষ, সরল সাদাসিধে,-বালকের মত প্রাণখোলা হাসি ছিল| প্যাঁচ বুঝতেন না| অসাধরণ স্মরণশক্তি, অত্যন্ত সুবক্তা ছিলেন| পড়াতেন খুব ভাল; ওঁর extempore বক্তৃতা আমি অন্তত দুজায়গায় শুনেছি, মনোমুগ্ধকর| টাকাপয়সার চিন্তা করতেন না,-করতে পারতেন ও না| সেটা সামলাতে হোত মাকে| আমার মা ছিলেন জমিদারের বড় মেয়ে, দাদু হেমচাঁদ গুপ্ত পোষ্যপুত্র ছিলেন| বিশাল জমিদারী ছিল টাঙ্গাইলের কেদারপুরে| পরে সেখানকার বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে যাওয়ায় দিনাজপুরে বালুরঘাট বালুবাড়িতে বাড়ি কোরে উঠে যান| সেই বাড়িতে আমি গেছি, দিদিমার মৃত্যুর সময়, সম্ভবত ১৯৪১ সালে| দেশ ভাগের সময় সেই বাড়ি পূর্বপাকিস্তানে পড়ে| আমার তিন মামা ও পাঁচ মাসি ছিলেন| বড় মামা জুড়ান(জগদীন্দ্র নারায়ন গুপ্ত), মেজর নাম মনে নেই, তাঁর এক মেয়ে ঝুমরি ও দুই ছেলে , বুলবুল ও গৌতম |ছোট মামা দিলীপ চাঁদ গুপ্ত পুলিসে কাজ করতেন| এই দুই মামাই অত্যন্ত সুপুরূষ ছিলেন| বড় মামা দেশ ভাগের পর এদেশে চলে আসেন ও বেহালায় বাড়ি করেন| বোনদের মধ্যে মা বড়, তারপর ফুলি, বিয়ের পর থেকে মালদহে থাকতেন| তৃতীয় বেলি, বিয়ের পর ময়মনসিং সহরে শ্যাওড়া অঞ্চলে থাকতেন; মেসোমশায় হোমিয়োপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন, যদিও বড় একটা রুগী হোত না| পরের বোন রেণু এবং ছোটর নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না| মেশোমশায় কালিপদ সেন বেহালায়, বড় মামার বাড়ির পাশে বাড়ি করেছেন| ছোটমাসি চোখে মুখে কথাবার্তা বলতেন, মনে হোত যেন যুদ্ধ করছেন| বড় মামা ইংরেজিতে M.A.পাস, নারকেলডাঙ্গা মেন স্কুলে অনেকদিন পড়িয়েছেন| বেলি মাসির ছেলে মেয়ে হয় নি| আমাদের ময়মনসিং এর কলেজ রোডের বাসা থেকে ওদের বাসা প্রায় দুমাইল দূরে| আমরা সবাই মিলে গেলে মাসি খুব খুসি হতেন, লুচি ভাজতেন, মিষ্টি ইত্যাদি খাওয়া হত|
কলেজ রোডের বাসায় আমরা আট বছর ছিলাম, কলকাতায় উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসার আগে পর্যন্ত| ঘর দুটোতে সারি সারি চৌকি(তক্তপোষ) পাতা ছিল, মাঝে কোন ফাঁক ছিল না| বড় ঘরে আমি শুতাম বাবার পাশে, তারপর মন্টু, সেজদা, তারপর দিদি| অন্য ঘরে মার পাশে জয়ন্ত; মেজদা পুরো একটা চৌকি নিয়ে শুত| বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না, ফ্রিজ তো ছিলই না, রোজ বাজার করতে হত, কারন আমরা দুবেলা মাছ খেতাম| মা দুবেলা উনুন ধরিয়ে রাঁধতেন| ছুটির দিনে দুপুরে আমরা মেজেতে আসন পেতে বসে খেতাম| অগুরু, নিমাই, নিতাই, খুকু, দুলাল, মন্টু, খোকন(জয়ন্ত) ও বাবা সবাই খাবার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছে| দিদি(খুকু) মাকে পরিবেশনে সাহায্য্ করত| জল দেওয়া হত কাঁসার গ্লাসে| পদ বেশি হোত না, ডাল ভাত, ভাজা, মাছের ঝোল, মাঝে সাঝে তরকারি হোত| আমি ডাল আর আলুভাজা খেতাম| রুই মাছ ছাড়া অন্য মাছ ভালবাসতাম না| এক রবিবার, সেজদা(নিতাই) বাজার থেকে বেশ বড় একটা আঢ় মাছ কিনে আনে, কমপক্ষে তিন কিলো| খুব ভাল মাছ, সবার ক্ষিদে বেড়ে গেল| মা জিজ্ঞেস করছেন, আর ভাত লাগবে কারু? মেজদা, সেজদা দুজনেই বলছে, আর একটু দাও| এইভাবে হাঁড়ি খালি, মার খাবার ভাত নেই| উনুন নিভে গেছে| মা হয়ত চিড়ে মুড়ি কিছু একটা খেলেন| কতদিন যে এমন হয়েছে! মার জন্য খাবার অবশিষ্ট নেই দেখে আমার খুব খারাপ লাগত| হয়ত সেজন্য এতদিন পরে, হয়ত বা ৭০/৭৫ বছর পরে ও মনে রয়ে গেছে|
ময়মনসিং এ খুব বৃ্ষ্টি হত| বৈশাখ মাস থেকে আশ্বিন মাস বর্ষাকাল ছিল| আমার বৃষ্টি খুব ভাল লাগত| রাত্রে রান্নাঘরের টিনের চালে ঝম্ ঝম্ বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম| বাবার ঘুম ভাঙ্গত খুব ভোরে, বোধ হয় সাড়ে চারটের সময়| ঘুম ভাঙ্গলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্তোত্র আবৃত্তি করতেন| নানা সংস্কৃত স্তোত্র, কবিতা, তারপর রবীন্দ্রনাথের কবিতার অংশবিশেষ| শুনে শুনে ঐ ছোট বয়সেই আমার সব কবিতা/স্তোত্র মুখস্ত হয়ে যেত| ছোটবেলায় আমার স্মরণশক্তি অসাধারন ভাল ছিল| একটা কথা একবার/দুবার শুনলেই মুখস্হ হয়ে যেত| কিছু স্তোত্র আবার পুজোয় লাগে| পরীক্ষার আগে, শেষ রাতে লন্ঠন জ্বালিয়ে আমরাও স্তোত্র পাঠ কোরে পরীক্ষার পড়া শুরু করতাম| আমি অবশ্য স্কুলের পড়া বিশেষ পড়তাম না| বাবা একদিন ধরলেন, দুলাল(আমার ডাক নাম) তুই পড়তে বসিস না কেন? আমি উত্তর দিলাম, আমার সব মুখস্হ| সত্যি সত্যি মুখস্হ কিনা, বাবা বই হাতে পড়া ধরলেন| মুখস্হ নেই এমন কিছু পাওয়া গেল না|
বংশ-পরিচয় নিয়ে বলতে বলতে কোথায় চলে গেলাম| আমার বড়দাকে আমরা দাদা বলি,- সুরেশপ্রসাদ বিভিন্ন দিকে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন| Economics ও বাংলায় M.A. চাকরি করেছেন A.G.Bengal, কলকাতা এবং অবসর সময়ে রাত জেগে গবেষণা| শেষ বয়সে তন্ত্র-সাধনায় মগ্ন ছিলেন| মেজদা technical diploma নিয়ে সিন্ধ্রি engineering college এ assistant instructor ছিলেন| কর্মস্হলে প্রবল ঝগড়া, হয়ত বা মারামারির কারনে চাকরি ছেড়ে বেনারসে চলে এলেন, দীক্ষা নিলেন, দাড়ি রাখলেন| সেজদা শিবেশ, আমি প্রদীপ ও আমার পরের ভাই দীপক-আমরা তিন ভাই কলকাতার Presidency college থেকে যথাক্রমে Statistics ও Mathematics , first class Honours লাভ করে B.Sc. পাস করি 1955 ও 1958 এ| তখনকার দিনে Honours এ first class পাওয়া বিশেষ কঠিন ছিল| এরপর সেজদা W.B.C.S. হন| আমি Applied Mathematics নিয়ে M.Sc. পাস করি ও Jadavpur University তে lecturer হই| অতঃপর Germany র Aachen Tech. University থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরে আসি| পরে IIT Kharagpur এ Mathematics এর Professor হয়ে 18 বছর কাজ করে Retire করি| আমার ছেলে মেয়েরা হল,-চন্দ্রা, সূর্য(সন্দীপ), ধ্রুব(শুভদীপ)| জামাই অনির্বাণ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Electrical engineering পাস করে Management এ ডিগ্রি ও ডক্টরেট করে এখন পুণেতে International school of Business and Media র ডিরেক্টর| ওদের এক মেয়ে মুনিয়া(বিপাসা) H.S. দিচ্ছে|
সূর্য iit kgp থেকে Chemistry তে M.Sc. করে University of California Riverside থেকে Nano Technology তে Ph.D. করেছে| San Hose, Ca তে সস্ত্রীক থাকে| স্ত্রী পরাগ iit kgp থেকে Chemistry তে M.Sc. করে U.S.A. যায় ও Management degree লাভ করে John Hopkins থেকে| বর্তমানে SFO তে একটা ব্যাঙ্কে কাজ করে| ছোট ছেলে ধ্রুব(শুভদীপ) iit kgp থেকে M.Sc. করে Computer specialize করে| পুণেতে IBM এ কর্মরত| স্ত্রী অনিন্দিতা বিশ্বভারতী থেকে Chemistry তে M.Sc. করে| পুণেতে একটি মিশনারি স্কুলে পড়ায়| ধ্রুব অনিন্দিতার দুই ছেলেরা হল,-সমু(সৌম্যদীপ) ক্লাস এইট ও অভ্র(অভ্রদীপ) ক্লাস ফোরে পড়ে|(এখন ২০১৯ সালে ওরা যথাক্রমে নাইন ও ফাইভে উঠেছে)|
দিদির গানের গলা ছিল খুব মিষ্টি, নিজে নিজেই সব শিখেছে| শিল্পকলায় বিশেষ পারদর্শীনি ছিল, যেমন, সূচীশিল্প, আল্পনা দেওয়া, ছবি আঁকা, পেন্টিং| পরবর্তীকালে বেনারসে “উকিল’স স্কুল অফ আর্টস” থেকে পেন্টিং এ ডিপ্লোমা লাভ করে| M.A. পাস করে, সম্ভবত Psychology তে| কসবার একটা স্কুলে সারাজীবন হেড-মিস্ট্রেস ছিল| গানের শিক্ষক রেখে দিদিকে গান শেখানোর আর্থিক সঙ্গতি বাবার ছিল না| নিজের চেষ্টায় শুনে শুনে যা শেখা সম্ভব তাই শিখেছে| জামাইবাবু খুব সরল, বিচক্ষণ লোক ছিলেন, A.G. Bengal এ কাজ করতেন| ওদের একই ছেলে, গোরা(দেবাশিষ সেন)একটি multinational co. তে কাজ করে| ভাল গান গায় ও গানে interest আছে|
আমার ছোট ভাই মন্টুর(দীপক) গানের গলাও খুব ভাল ছিল, নিজে নিজে তবলা বাজানো শিখেছিল| C.U., Radio Physics and Electronics বিষয়ে B.Tech, M.Tech. করে দুবছর IIT Kharagpur এ Electronics & Comm. Dept. এ অধ্যাপনা করার পর U.S.A. যায় Plasma Physics এ Ph.D. করতে| ভাল না লাগায় Computer এ কাজ নেয় এবং ওই দেশেই settle করে| ওর ছেলে সুদীপ আর মেয়ে রূমা, স্ত্রী মায়া| সাত বছর আগে মন্টু আমাদের ছেড়ে গেছে| আমাদের সবচেয়ে ছোট ভাই জয়ন্ত ও U.S.A. তে settled দীর্ঘদিন| Kidney র সমস্যা| স্ত্রী সুদেষ্ণা ও পুত্র পার্থদের নিয়ে ওরা ঐদেশেই রয়েছে| গত অক্টোবরে, জয়ন্ত আমাদের ছেড়ে চলে গেছে|
ঠাকুর্দার তৃতীয় ভাই ভবানীপ্রসাদের ছেলেদের মধ্যে আমি শচীজ্যাঠাকে দেখেছি| ওঁর ছোট ভাই ইন্জিনিয়র ছিলেন, থাকতেন কলকাতা মেডিকাল কলেজের কাছে, শ্রীগোপাল মল্লিক লেনে|এঁদের বাড়িতে যাবার আমার সুযোগ ঘটেনি বা আমি এঁদের দেখিনি| ঠাকুর্দার চতুর্থ ভাই রজনীপ্রসাদের তিন ছেলে| বড় জন ডেন্টিষ্ট, থাকতেন বালিগঞ্জে যতীনদাস রোডে, দ্বিতীয় জন বম্বেতে চাকরি করতেন, textile engineer, তৃতীয় জনের ডাক নাম খোকা| ১৯৫০/৫১ সালে এই কাকার বিয়েতে আমি গিয়েছিলাম, লেক রোডের বাড়িতে| স্ত্রী নারায়নী বিশেষ সুন্দরী ছিলেন| এঁদের মেয়ে উর্বষীর সঙ্গে আমার মামাশ্বশুর N.C.Roy এর শ্রাদ্ধে, নিউ বালিগঞ্জের বাড়িতে আলাপ হয়| তার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ও মারা যায়|
ঠাকুর্দার কনিষ্ঠতম ভাই, অবনীপ্রসাদ বাড়ি করেছিলেন 13 Deshapriya Park Rd. এ| ছেলেমেয়ে নাতি-নতনি সহ উনি ঐ বাড়িতেই ছিলেন|ঐ বাড়িতে আমি 1950 সালের ২৩শে মার্চ, কলকাতা চলে আসার পর থেকে অনেকবার গেছি, ও সবাইকে দেখেছি| অবনীপ্রসাদের তিন ছেলে,- হাবলি(ব্রজেন্দ্রপসাদ) IAS, পচু(বীরেন্দ্রপ্রসাদ) MRCP, MRCS ডাক্তার, গগু(সুধীন্দ্রপ্রসাদ) Applied Physics M.Tech, কাজ করতেন CESC তে| মেয়ে পুটলির দুই ছেলে ও এক মেয়ে| ছেলে অশোক জার্মানিতে ভারতের Ambassador ছিলেন, দ্বিতীয় ছেলে (নাড়ু) দীপক রায়, নাম করা ভাল ছাত্র, Geological Survey of India র Director general ছিলেন| এঁর দুই পুত্র iit kharagpur এ আমার ছাত্র ছিল(নাম ভুলে গেছি), দুজন ই সেরা ছাত্র, ছোটজন IIT র PGM(Presidents’ Goldmedalist)|
হাবলি, পচু ও গগু কাকার স্ত্রীরা হলেন যথাক্রমে ইন্দিরা, লহ্মী ও আসমানি| এঁদের আমি অনেকবার দেখেছি| ইন্দিরা কাকিমা অসাধারন সুন্দরি ছিলেন|
হাবলি কাকার ছেলে মেয়েরা হল,- যমজ মেয়ে রুন্টি ঝুন্টি, ছেলে বাচ্চু ও চাঁদ, পচু কাকার ছেলেরা হল রবি ও রঞ্জু আর গগু কাকার ছেলে সঞ্জু,-কাছাকাছি বয়সের| রুন্টিদি ও ঝুন্টিদি 1950 সালে ভালভাবে ম্যাট্রিক পাস করেন| ফল বের হয়, বোধ হয় জুলাই মাসের শেষ দিকে| তারপর ওদের বইপত্র আমাকে দেয়, আমার বিরাট উপকার হয়| অনকদিন ওদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই| সবাই বেঁচে আছে কিনা তাও জানিনা|
এবার আমার ঠাকুর্দার বোনদের কথা বলি| বড় জনের নাম অমৃতসুন্দরী,
বিধবা হয়ে পিতৃগৃহে থাকতেন| সৌদামিনী সধবা অবস্হায় মারা যান| দ্বিতীয়া কন্যা শশিমুখী| চতুর্থ ও পঞ্চম হলেন ভবতারিনী ও বিজয়ললহ্মী দেবী| এদের মধ্যে কে বড় কে ছোট জানিনা| বিজয়লহ্মীর পুত্র প্রখ্যাত গান্ধিবাদী নেতা, বিজ্ঞানী সতীশ চন্দ্র দাশগুপ্ত(14.6.1880-20.12.1979) খাদি-প্রতিষ্ঠান স্হাপন করেন| সোদপুরে তার বাড়ি “গান্ধি আশ্রম” নামে খ্যাত| শশিমুখী বা ভবতারিনীর মধ্যে একজনের কন্যার কন্যা ননী হলেন যাদবপুর বিশ্বিদ্যালয়ের উপাচার্য, যাকে ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর নক্সালরা হত্যা করে|
এই হল আমাদের family র সংক্ষিপ্ত পরিচয়|


Leave a comment