Dr. Pradip Niyogi's Blog

My write ups on a mixed bag of topics – from my perspective


Chande Jatayet

চাঁদে যাতায়াত

মহাকাশে চাঁদ আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী| চাঁদ সম্বন্ধে জানার কৌতূহল

আমাদের সুদীর্ঘকালের| সাম্প্রতিক ইতিহাসে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্হা ISRO র চন্দ্রযান-২ নামের প্রজেক্ট বিপুল প্রচার লাভ করে|  বিশেষ আবেগ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয় যখন ল্যাণ্ডার বিক্রম, চাঁদকে প্রদক্ষিণরত মহাকাশযান অরবিটার থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে এসে চাঁদে মসৃণ অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ও চন্দ্রপৃষ্ঠের খুব কাছে এসে পড়েছিল| দেশে বিদেশে, অনেকে T.V. ছেড়ে উঠতে পারছিলেন না|  পুরো ব্যাপারটা বিশাল মাত্রার প্রচার লাভ করে প্রধান মন্ত্রির উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের গবেষণাগারে উপস্হিতির জন্য|

আদিকাল থেকে, পূর্ণিমা রাতে মানুষ “চাঁদের বুড়িকে চরকা কাটতে দেখছে|” সপ্তদশ শতাব্দীতে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মহাকাশ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অনেক বাড়ে| আর মানুষের কৌতূহল বেড়েই চলে, বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার অগ্রগতির সাথে সাথে| দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে, জর্মান V-2 রকেট ইংলণ্ডের লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল আঘাত হানার সাথে সাথে মহাকাশ কারিগরি গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল| যুদ্ধে পরাজয়ে জর্মানিকে যে সব শর্ত মানতে বাধ্য করা হয় তার একটি হল, দশ বছর (1955 পর্যন্ত) জর্মানিতে aeronautics ও আনুসঙ্গিক বিষয় গবেষণা, চর্চা এমন কি পঠন-পাঠন নিষিদ্ধ হয়| এই সময় জর্মান মহাকাশ বিজ্ঞানিদের u.s.a, u.s.s.r বা u.k তে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়(জর্মানরা বলে freiwillig gezungen অর্থাৎ স্বেচ্ছায় যেতে বাধ্য করা হয়)|এর পরই এই সব দেশে মহাকাশ গবেষণার জোয়ার দেখতে পাওয়া যায়| 1961 সালের জুলাই মাসে ইতিহাস সৃষ্টি করেন সোভিয়েট মহাকাশচারি য়ুরি গাগারিন,  যিনি মহাকাশযানে চেপে মাধ্যাকর্ষণ বল অতিক্রম করেন ও পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন এবং নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসেন,- যা হল আধুনিক মহাকাশ গবেষণায় সর্বপ্রথম অবিস্মরণীয় সাফল্য|

 এই সময়, ষাটের দশকে, V-2 রকেটের স্রষ্টা ভেরনার ফন ব্রাউনকে আমেরিকায় মহাকাশ গবেষণা সংস্হা NASA র একটি কেন্দ্রের ডিরেক্টার রূপে দেখা যায়| NASA 1969 সালে অ্যাপোলো মিশন-11 নামের প্রজেক্টে তিন মহাকাশচারিকে চাঁদে পাঠায় ও নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনে| চাঁদে কোমল অবতরণের(soft landing) সঙ্গে সঙ্গে মহাকাশ গবেষণায় নতুন যুগের সৃষ্টি হল, বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যায় অভাবনীয় সাফল্য এল| এর ফলে নিরাপদে চাঁদে যাতায়াত সম্ভব হল| সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ তিনটি দিকের একটি হল, রকেট কারিগরি বিদ্যায় পারঙ্গম হওয়া, দ্বিতীয়টি হল চাঁদে কোমল অবতরণ আর তৃতীয়টি হল নিরাপদে ফিরে আসা| এই তিনটি বিষয়ে NASA সুদীর্ঘ গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে এবং সাফল্য লাভ করেছে| অজস্র খুঁটিনাটি এর সঙ্গে জড়িত যেগুলো কোনো দেশ অন্য কাউকে বলে না বা প্রকাশ করে না, নিজেকে আবিষ্কার করে নিতে হয়|

চন্দ্র থেকে মহাকাশযানটির ফেরা নিঃসন্দেহে দুরূহ, কারন মহাকাশযানটি তীব্র বেগে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যখন প্রবেশ করবে তখন যানটির সম্মুখে একটি বিচ্ছিন্ন শকের সৃষ্টি হবে যার ফলে যানটির উত্তাপ বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে| এরূপ প্রচণ্ড উত্তাপে পরিচিত সকল ধাতুই গলে যায়| সিরামিক পদার্থ ব্যবহারে কিছুটা সুফল এসেছে| পরবর্তী গবেষণায় বায়ুমণ্ডল এমন করিডর আবিষ্কার হয়েছে যেখান দিয়ে অবতরণ করলে উত্তাপের বৃদ্ধি সবচেয়ে কম হয়| এই করিডর ব্যবহার কোরে সাফল্য এসেছে|

মহাকাশ কারিগরিতে আমাদের দেশ খুবই এগিয়ে| রকেট কারিগরিতে ভারতের অভিজ্ঞতা ও পারদর্শিতা সবিশেষ স্বীকৃত| এর সঙ্গে যুক্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডঃ এ.পি.জে. আব্দুল কালামের নাম যিনি এবিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন| চন্দ্রযান-2 এর নির্ভুল উৎক্ষেপণ ও  অরবিটারকে পূর্বনির্দিষ্ট কক্ষপথে প্রতিস্হাপন এবং ল্যাণ্ডার বিক্রমকে বিচ্ছিন্ন করে চন্দ্রপৃষ্ঠে কোমল অবতরণের  জন্য প্রস্তুত করা- এসবই আমাদের বিজ্ঞানিদের অসামান্য কৃতিত্বের নিদর্শন| চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে 2.1 কি.মি. দূরত্বে হঠাৎ বিক্রম উধাও হয়ে যায়| ভূপৃষ্ঠের গবেষণাগারের সঙ্গে বিক্রমের সংযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়| এর কারন সম্বন্ধে ISRO কোন কিছু প্রকাশ করেনি, যদিও NASA সম্প্রতি জানিয়েছে যে, “বিক্রম চন্দ্রপৃষ্ঠে crash-land করেছে, বা আছড়ে পড়েছে|”

চন্দ্র ও অন্যান্য গ্রহে যাত্রায় একটি প্রধান সমস্যা হল, সঠিক যাত্রাপথ নির্ণয়| আলোচ্য যাত্রাপথ নির্ণয়কারি প্রধান বল হল মাধ্যাকর্ষণ| প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পৃথিবী, মহাকাশযান এবং চন্দ্র(বা অন্য কোন গ্রহ)- এই তিনবস্তুর মাধ্যাকর্ষণ দ্বারা সৃষ্ট গতিপথ নির্ণয়ের যে সমস্যা, গণিতজ্ঞরা বহুকাল ধরে চেষ্টা করেও তার সমাধান করতে পারেন নি| সমস্যাটি “থ্রি বডি প্রবলেম(Three Body Problem)” নামে বিখ্যাত|( এই সমস্যায় উদ্ভূত গাণিতিক সমীকরণ গুলির সংখ্যা অজ্ঞাত রাশিগুলির সংখ্যার চেয়ে কম)| উপরোক্ত তিনবস্তুর মধ্যে মহাকাশযানটির ভর তুলনায় খুব কম হলেও গুরূত্বের দিক থেকে আমাদের কাছে অগ্রাহ্য করার মত নয়, কারন মনে রাখতে হবে এই মহাকাশযানে চড়েই আমরা অন্য গ্রহে পাড়ি দিচ্ছি| পৃথিবীতে আমরা যে দূরত্বের সঙ্গে পরিচিত, গ্রহান্তর যাত্রায় দূরত্ব তার অনেক বেশি| কাজেই, যাত্রাপথ নির্ণয়ে সামান্যতম ভুল ও মারাত্মক হতে পারে| বিশেষ প্রয়োজনে সমস্যাটির আসন্ন সমাধান দিয়ে কাজ চালানো হয়| চন্দ্রযান-2 কিন্তু এই সমস্যার সুষ্ঠু আসন্ন সমাধান কোরেছে বলেই মনে হয় এবং অরবিটারকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে প্রতিস্হাপন করেছে| তাহলে ল্যাণ্ডার বিক্রমের কেন এমন হোল? ISRO বা NASA কিন্তু এর উত্তর দেয় নি| এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর অতিশয় দুরূহ| সহজ বুদ্ধিতে আমরা যা বুঝি তা এখানে খুব সংক্ষেপে আলোচনা করছি| তার আগে আর একটি বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করছি| বিষয়টি হল, দুটি ভিন্ন কক্ষপথে পরিভ্রমণকারি মহাকাশযানের মিলন বা সংক্ষেপে রাঁদেভূ(Rendezvous)| অরবিটার ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময়, বিক্রমের বেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ছয়হাজার কিলোমিটার| পাঁচটি পর্যায়ে রেট্রো-রকেট ছুঁড়ে এই বেগকে শূণ্যর কাছে নিয়ে গিয়ে বিক্রম ও চন্দ্রের রাঁদেভূ ঘটানো হবে(isro র বক্তব্য অনুযায়ী)| সম্ভবত এখানেই হিসাবে গোলমাল ঘটেছে, এবং নির্ণেয় সময়ের যৎসামান্য আগেই বিক্রমের বেগ শূণ্যের কাছে পৌঁছয়| ফলত, প্রধানত চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে বিক্রম 2.1 কিলোমিটার দূরত্বের চন্দ্রপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ে| মোটামুটি হিসেবে দেখা যায়, এই দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগে দেড় সেকেণ্ডের ও কম, চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ g/6 ধরে, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ g ধরে| একটা বিশাল কাজে অতি ক্ষুদ্র ত্রুটি| এই ত্রুটি সত্তেও ISRO র বিজ্ঞানিদের কৃতিত্ব অনন্যসাধারণ| তাঁদের আমাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই|

—-প্রদীপ নিয়োগী



Leave a comment