Dr. Pradip Niyogi's Blog

My write ups on a mixed bag of topics – from my perspective


My First Germany trip

আমার প্রথম জার্মানি  যাত্রার স্মৃতিচারণ

আমি জার্মানি গেছি তিন বার| প্রথমবার যাই 1961, July, চার বছরের জন্য, দ্বিতীয়বার 1971  সালে দুমাসের জন্য, আর তৃতীয়বার 2012 সাল, দুসপ্তাহের জন্য| প্রথমবার ভ্রমণের কথা এখানে লিখছি|

যে কথা লিখতে বসেছি তা  দীর্ঘ ৫৭ বছর আগের কথা, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন এই সেদিন ঘটেছে। আমি তখন ২৫ বছরের যুবক। জার্মানির আখেন সহরে  যাচ্ছি গবেষণা করতে। পাঠকদের সুবিধার্থে নিজের কথা কিছু বলে নিচ্ছি।

 কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিত বিষয়ে এম্.এস্.সি. পরীক্ষা পাস করি ১৯৫৭ সালে যদিও ফল বের হয় ১লা ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৮। ফল বের হবার চার মাস পরেই আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের লেকচারার পদে নিযুক্ত হই। আজকের দিনের সেরা ছাত্রদের যেখানে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে দেখি, তখন  তাদের তুলনায় নিজেকে খুবই ভাগ্যবান বলে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে, সেটা ছিল ভারত স্বাধীন হবার অল্প দিন পরের সময়।

স্বাধীন ভারতের কর্ণধাররা মনে করলেন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যা শিক্ষার যথেষ্ট বিস্তার ও প্রসার দরকার। এই লক্ষ্যে, এই সময়ে অনেক কলেজ, ইন্জিনিয়ারিং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয় । এর কিছুদিন আগে খড়্গপুরে ভারতের প্রথম আই.আই.টি.(ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পুরনো ইন্জিনিয়ারিং কলেজ বেঙ্গল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট, নতুন চেহারায় দেখা দিয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। কোন রকম পড়ানোর অভিজ্ঞতা বা গবেষণার ডিগ্রি বা প্রকাশিত গবেষণা পত্র ছাড়া, সহজেই এখানকার শিক্ষক নিযুক্ত হতে পেরে আমি বেশ খুসি হলাম। এভাবেই আমার কর্ম জীবনের ভবিষ্যৎ নির্দিষ্ট হয়ে গেল।

 তখনকার দিনে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষকদের বেতন বড়ই কম ছিল। শিক্ষকতার চাকরি হৃষ্ট চিত্তে গ্রহণ করেছি জেনে আমার বাবা মাকে বললেন,’ ছেলেটা দেখছি খেতে পাবে না।‘ বাবার সারা জীবন কেটেছে শিক্ষকতায়। অর্থকৃচ্ছতা পিছু ছাড়ে নি কখনো। তাই বড় দুঃখে কথাগুলি বলেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে, অল্প কিছুকাল পর থেকেই শিক্ষকদের আর্থিক সঙ্গতি বারে বারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আর্থিক দৈন্যদশা নেই বললেই চলে।

নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বহু সংখ্যক শিক্ষকের প্রয়োজন। অনেকক্ষেত্রে উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন কাউকে না পেলে সদ্য পাস করাদের নিযুক্ত করা হয়েছে। যাই হোক, যাদবপুরে শিক্ষকতা বেশ ভালই লাগছিল। বেশিরভাগ মাস্টারমশাইরা আমার কাছাকাছি বয়সের এবং অবিবাহিত হবার জন্য নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব আড্ডা ভালই জমত। শুধু আড্ডা বেশি দিন ভাল লাগে না। মাথায় ঢুকল গবেষণা করতে হবে। সহপাঠী বন্ধুরা গবেষণা করছে, কেউ আবার Ph.D. হয়ে যাচ্ছে। গবেষণা করতে হলে একজন উপযুক্ত গাইড চাই যিনি গবেষককে সঠিক পথ-নির্দেশ করেন, বিষয় নির্বাচনে সাহা্য্য করেন, গবেষকের ভুল ভ্রান্তি দেখিয়ে দেন বা প্রয়োজনে শুদ্ধ করে দেন। ১৯৫৭ সাল বা তার পরবর্তি বেশ কিছুকাল কলকাতায় ফলিত গণিতে গাইডের বেশ অভাব ছিল। আমাদের সহপাঠিরা অনেকে প্রখ্যাত অধ্যাপক বিভূতি ভূষণ সেনের কাছে গবেষণা সুরু করেন।  উনি প্রধানত Elasticity বিষয়ে কাজ করান। Fluid Dynamics বিষয়ে ও কয়েকজন ওঁর কাছে গবেষণা কোরে Ph.D. ডিগ্রী লাভ করেন।  

 আমি আমাদের মাস্টারমশাই অধ্যাপক এন.আর.সেন(অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন সেন)-এর কাছে গিয়ে গবেষণা করার কথা বললাম। উনি আমাকে গাইড করতে রাজি হলেন। এম.এস.সি. পড়ার সময় উনি আমাদের স্পেশাল পেপার Ballistics এবং Theory of  Compressible Fluid Flow(আধুনিক ও সংক্ষিপ্ত নাম Gasdynamics) পড়িয়েছিলেন। এই সময় Lipman Bers –এর লেখা Mathematical Theory of Subsonic and Transonic  Gasdynamics বইটা বের হয় । এক কপি কিনে আমি পড়া আরম্ভ করি। যত টুকু বুঝি পড়ে যাই। বিষয় টা আমার ভাল লাগে। গবেষণার বিষয়, আমার পছন্দ অনুযায়ী ট্র্যানসনিক প্র্রবাহ (Transonic Flow) স্হির হল। বিষয়টি একদম নতুন। অধ্যাপক সেনের ও পড়া নেই বা জানা নেই বললেন। আর ও  বললেন, ‘তুমি কতগুলো পেপার পড়ে present করবে, আমি শুনব। তার থেকেই বেরিয়ে আসবে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের নতুন গবেষণা কাজের topic বা বিষয়।‘ প্রেজেন্ট করার পেপার নির্বাচন কিভাবে করব, তার উত্তরে বললেন, একাধিক পেপার যে পেপারটিকে নির্দেশ করে বুঝতে হবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। সুদীর্ঘকাল ফলিত গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক পদ অলংকৃত করেছেন। ভারতবর্ষে ফলিত গণিত শিক্ষার পথিকৃৎ, অধ্যাপক সেন সবে তখন  অবসর নিয়েছেন ।

 উনি আরও বললেন, যে উনি সপ্তাহে দুদিন কোরে যাদবপুরে কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স এ জাতীয় অধ্যাপকের(অধ্যাপক সত্যেন্দ্র নাথ বসু)ঘরে বিকেল চারটে থেকে বসবেন। দিন স্হির করে লেগে গেলাম গবেষণার কাজে। একাধিক লাইব্রেরি ঘুরে, বিভিন্ন জার্নাল ঘেঁটে অল্প স্বল্প বোঝা যায় এমন একটি পেপার নির্বাচন করলাম। লাইব্রেরিতে বসে পুরো পেপারটা খাতায় কপি করলাম। এখনকার মত জেরক্স করার সুবিধে তখন ছিল না, বোধ হয় জেরক্স তখনো আবিষ্কার হয় নি। এর পর বাড়িতে বসে পেপারটি পড়া সুরু করলাম। অনেক জিনিস ই অজানা। তাও বারে বারে পড়ে মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করে গেলাম। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে কাল্টিভেশনে জাতীয় অধ্যাপকের ঘরে উপস্হিত হয়ে পেপারটি present করা সুরু করলাম। অধ্যাপক সেন প্রচুর প্রশ্ন করলেন। কিছু উত্তর জানা, অনেকটাই অজানা । উনি নিজেও ভেবে উত্তর বের করলেন। এই ভাবে ঘন্টা দেড়েক চলল। সে দিনের মত অধিবেশন শেষ। পেপারটি প্রায় তিরিশ পাতা। প্রথম দিন দু তিন পাতার বেশি এগোল না। এই ভাবে আমার গবেষণা-জীবন শুরু হোল।

  আমার বেশ কয়েকজন সহপাঠি ও বন্ধু কাছেই থাকতেন। কয়েকজন আবার যাদবপুরে গণিত বিভাগে আমার সহকর্মী ছিলেন।  আমার গবেষণা শুরুর খবর সবাই জানলেন। আমার ঘনিষ্ট সহপাঠী কয়েকজন আমার presentation seminar  এ উপস্হিত হতে চাইলেন। অধ্যাপক সেন এদের সবাই কে সাদর আমন্ত্রণ করায় কেউ কেউ উপস্হিত হতে লাগলেন। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন সহপাঠি ও বন্ধু বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ও বৈদ্যনাথ বসু। ট্র্যানসনিক প্রবাহ বিষয়ে এদের আগ্রহ না থাকলেও এরা কিন্তু আমার presentation এ যোগ দেওয়া সময়ের অপচয় বোলে মনে করেন নি। বিশ্বনাথ এই সময়ে Plasma Dynamics এবং

বৈদ্যনাথ astrophysics বিষয়ে নিজে নিজেই পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছিলেন। কাল্টিভেশনে আমাদের সেমিনার ভালই চলছিল। মাঝে মাঝে অনেকে আসতেন এন.আর. সেনের সঙ্গে দেখা করতে, এবং প্রেজেন্টেশন শুনতে বসে যেতেন। একদিন অধ্যাপক সত্যেন বোস এলেন এবং নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ শুনলেন। অধ্যাপক বোসকে ইতিপূর্বে একাধিক সেমিনারে যোগ দিতে দেখেছি। উনি চোখ বন্ধ কোরে চুপ চাপ শুনতেন।

 প্রসঙ্গত বলি, এক সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে খ্যাতনামা অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট অধ্যাপক নারলিকর কলকাতায় সাহা ইন্সটিউট সভাগৃহে বক্তৃতা করতে এসেছিলেন। তিনি স্মরণ করলেন, ১৯৬৬ সালে তিনি ঐ সভাগৃহে unified field theory র উপর তাঁর ও ফ্রেড হয়েলের কাজ প্রেজেন্ট করেন। এই বিশেষ কাজটি তখনকর দিনে বিজ্ঞানি-মহলে বেশ আলোড়ন তোলে। খবরের কাগজে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই কাজ তরুন ডঃ নারলিকর যখন  এখানে উপস্হাপিত করেন, তখনও অধ্যাপক বোস চোখ বন্ধ কোরে পুরো বক্তৃতা শুনে গেছেন, কোন মন্তব্য বা প্রশ্ন না কোরে। পরের দিন, আলাদা কোরে ডেকে ওঁকে কতগুলি প্রশ্ন করেন, যার উত্তর ওঁর জানা নেই এবং ওঁর কাজে বিশেষ প্রভাব ফেলে।

   অধ্যাপক সেনের শরীর মাঝে মাঝেই খারাপ হয়ে পড়ছিল। চাকরি জীবনের শেষ বছর, উনি আমাদের স্পেশাল পেপার পড়িয়েছেন। আমরা তিন জন ছিলাম শুরুতে, যদিও অল্প দিনের মধ্যেই অন্য দুজন ছেড়ে দেয়। সারা বছর একা আমাকে উনি পড়িয়েছেন। তখন ই দেখেছি, উনি প্রবল dust- allergy তে ভুগছেন। ব্ল্যাক-বোর্ডে চক দিয়ে কিছু লিখতে পারতেন না, মুছতে তো পারতেন ই না। বোর্ডে চক দিয়ে লেখা ও মোছার কাজটা করতেন ডঃ ক্ষেত্রমোহন ঘোষ, যিনি ওঁর কাছেই turbulence বিষয়ে গবেষণা কোরে Ph.D. করেছেন। এই অ্যালার্জি আরও প্রবল আকার ধারণ করে অবসর জীবনে। তাই মাঝে মধ্যেই আমদের সেমিনার বন্ধ থাকত। মনে হত উনি আর বোধ হয় আমাদের গাইড করতে পারবেন না। এইভাবে বছর খানেক বছর দেড়েক কাটল। একটু হতাশ হয়ে অন্য গাইডের কাছে গেছি, যদি তারা রাজি হন। অধ্যাপক বিভূতি সেন  রাজি হলেন না, হয়ত ওঁর কাছে প্রথমে যাই নি বোলে।

শেষ চেষ্টা করলাম অধ্যাপক শুদ্ধোদন ঘোষের কাছে, যদিও জানতাম যে উনি অনেক দিন কাউকে গবেষণা করাচ্ছেন না। অধ্যাপক ঘোষ বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না কোরে বললেন, “বিদেশে চেষ্টা কর, বিদেশে যাও”। আমি এই উপদেশ গ্রহণ কোরে বিদেশে তিন  প্রখ্যাত অধ্যাপকের কাছে চিঠি লিখলাম, i) New York, Courant Institute, ii) Germany, Aachen,

Prof. Klaus Oswatitsch, iii)Paris, Prof. Germain.

এঁদের প্রত্যেকেই ট্র্যানসনিক প্রবাহ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।

চিঠির উত্তর সর্বপ্রথম পেলাম অধ্যাপক অসভাটিচের কাছ থেকে, মাত্র দশ দিনের মাথায়। উনি সাদর আমণ্ত্রণ জানিয়েছেন এবং সঙ্গে ৫০০ ডে-মা্র্ক স্টাইপেন্ডের ব্যবস্হা। আমিও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই  acceptance

জানালাম। এটা ১৯৬০ সালের প্রথম দিকের কথা। মনে হোল ভাগ্যলক্ষ্মী মুখ তুলে তাকিয়েছেন।

এই বার শুরু হোল বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি। মোটমুটি স্হির হোল, মাস ছয়েক পরে, ডিসেম্বর ১৯৬০ নাগাদ,

 আমি আখেনে যাব, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Study Leave নিয়ে। এই মর্মে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে through proper channel দরখাস্ত করলাম। সাধারণত তিন বছরের সবেতন ছুটি পাওয়া যায়। জার্মান ভাষা শেখার জন্য কলকাতার Max Mueller ভবনের  অন্তর্গত  Goethe                   Institute এর ছয় মাসের rapid course এ ভর্তি হলাম। একদিন, অধ্যাপক এন.আর.সেনের বাড়ি গিয়ে ওঁকে জানালাম। উনি শুনে খুব খুসি হলেন। কিছু উপদেশ দিলেন। এর আগেও একবার দুবার আমি ওঁর বাড়ি গিয়েছি, নানা কারনে। প্রত্যেকবার  ই উনি কিছু  না কিছু মূল্যবান উপদেশ দিয়েছেন যেগুলো আমার খুবই কাজে লেগেছে। একটি উপদেশ আমার এখনো মনে আছে। এম.এস.সি. পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর এক দিন  যখন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই, উনি বললেন,” পড়ার অভ্যেসটা কিন্তু ছেড় না। রোজ সকালে দুঘন্টা নতুন বিষয় শেখার জন্য ব্যয় করবে। নানা কাজে হয়ত জড়িয়ে পড়বে, কিন্তু পড়ার অভ্যেস ছাড়বে না”। নতুন গবেষকদের পক্ষ্যে এটি অমূল্য উপদেশ। Class-room lecture  -এর সময় উনি বলেন,” যখনই কোন mathematical equation or relation পড়বে তখন তার physics টা নিয়ে ভাববে, বোঝার চেষ্টা করবে। তার পরে অঙ্ক। অঙ্ক সোজা, সবাই পারে।“ ওঁর উপদেশ সাধ্যমত মনে রাখার চেষ্টা করেছি। অন্য ছাত্র-ছাত্রিদের কাজে আসতে পার ভেবে এখানে লিখলাম।।

কি বলতে শুরু করেছিলাম, আর কোথায় চলে গেলাম। আজকাল কার ছেলে মেয়েরা তো ওঁদের দেখেনি, অন্তত আমার স্মৃতিচারণ পড়ে সেই স্বর্ণযুগের কথা একটু জানুক।

বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে কথা হচ্ছিল। সর্বাগ্রে যা দরকার তা হোল Passport and Visa. তার সঙ্গে দরকার পর্যাপ্ত পরিমান অর্থ। এর প্রত্যেকটি আমায় ভুগিয়েছে। এর পর দরকার একটা ভাল এবং সঠিক travel-plan.

তখন কলকাতায় এখনকার মত এত travel-agent –এর ছড়াছড়ি ছিল ন। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম ডালহৌসিতে হরি সিং travel-agent আছে যারা এই কাজ করে। সোজা সেখানে উপস্হিত হলাম একদিন। ওরা অবিলম্বে  পাসপোর্ট এর জন্য

পাসপোর্ট অফিসে (৪নং, ব্রেবোর্ন রোড) গিয়ে দরখাস্ত করতে বলল। ওদের কাছে জানলাম, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট পর্যন্ত air fare (ভাড়া) ১৮০০টাকা, আর

জাহাজে বম্বে-জেনোয়া(ইটালির বন্দর), তা্রপর ট্রেনে কোলোন হয়ে আখেন। জাহাজ ভাড়া লাগবে ১২০০টাকা, ট্র্রেনের ভাড়া বাড়তি। টাকার কথা বিবেচনা করে আমি জাহাজেই যাব, ওদের  জার্নি বুক করতে বললাম। ইটালিয় লাক্সারি জাহাজ Lloyed Triestino তে বুক করে রাখা হল।

এইবার শুরু হল অর্থচিন্তা, টাকা পাব কোথায়? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, সংক্ষেপে JU , থেকে মায়না পাই ৩০০টাকার কিছু কম। মূল ২৫০৷- D.A. ৪০। এক বছর পর চাকরি দৃঢ়ীভূত হয়ে গেলে

P.F কাটে, আর কাটে income tax. থাকতাম দাদার বাসায়, ভবানিপুরে। খরচ ও ছিল প্রচুর। তারপর প্রত্যেক মাসেই কিছু না কিছু বড় খরচ লেগেই থাকত। যেমন, আমার কোন রিস্ট ওয়াচ ছিল না। রিস্ট ওয়াচ ছাড়া ক্লাসে বড় অসুবিধে হোত, ক্লাস শেষ হল কিনা বুঝতে পারতাম না। তাই দ্বিতীয় মাসের  মায়নায় একটা anglo-swiss cavalry ঘড়ি কিনি ১৬০টাকায়। প্রথম মাসের মায়না থেকে দাদাকে ২০০টাকা দিই একটা সেগুন কাঠের ডবল-খাট কেনার জন্য।  পুজো উপলক্ষ্যে নিকট আত্মীয়- স্বজনদের জামাকাপড় দিতে হয়, নিজের জামাকাপড়ের কথা বাদ ই দিলাম। ভবানীপুরে দাদার বাসায় থেকে আমি আর আমার সেজদা শিবেশ B.Sc. , M.Sc. পড়েছি। দুজনেই প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তাম। মায়না বেশি বলে অবশ্য এম.এস.সি প্রেসিডেন্সি তে না পড়ে রাজা বাজার সায়েন্স কলেজে পড়ি। আমি আর সেজদা এক ঘরেই থাকতাম, মেজেতে সতরঞ্চির উপর বিছানা। পাশে বইপত্র। আমি ঘুম থেকে উঠে, বিছানা তুলে সতরঞ্চির উপর বসে পড়াশোনা করতাম। সেজদার বিছানা

তোলার বালাই ছিল না। বই খাতা বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকত। আমি দুটো কেরসিন কাঠের চৌকি, বইপত্র রাখার সস্তার কাঠের সেলফ কিনি। প্রথম সুযোগেই দুটো সিলিং ফ্যান কিনি| দাদা-বৌদির ঘরে একটা ভাড়া করা ফ্যান চলত, মাসে আট টাকা ভাড়া| সেটিকে বিদায় করা হোল|

 মা বাবা দিদিও তিন ভাই বেনারসে থাকতেন। কিছুদিন পর আমার ছোট ভাই মন্টু ও প্রেসিডেন্সি কলেজ বি.এস.সি. তে ভর্তি হয়। তত দিনে সেজদা W.B.C.S. হয়ে চাকরি সুরু করেছে আর সেজদার চৌকি মন্টু(দীপক) দখল করেছে। এত কথা বলার অর্থ এই যে আমার সঞ্চয় শূন্যই থাকত। তবে অন্য একটা আয়ের সুযোগ আসে।

এই সময় পুরোনো স্কুল-ফাইনালের পরিবর্তে  তিন বছরের উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্হা চালু হয়। Bookland Publishing এর কর্ণধার জানকীনাথ বসু মশায়ের বিশেষ অনুরোধে এম.এস.সি. পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই আমি বাংলায় উচ্চমাধ্যমিক্ ত্রিকোনমিতি বই লেখা সুরু করি। যথাশিঘ্র বই ছেপে বের হল। পাবলিসার  বিভিন্ন স্কুলে ফ্রি-কপি পাঠাতে লাগলেন। বাংলায় লেখা উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরের অঙ্কের বই এটাই প্রথম। বিভিন্ন স্কুলের গণিতের মাস্টারমশায়রা বইটির যথেষ্ট প্রশংসাও করলেন, কিন্তু অন্য অঙ্কের অর্থাৎ সহযোগী বই তখনো প্রকাশিত না হবার জন্য আমার বইটিকে পাঠ্য করলেন না। বিক্রি নেই, কাজেই কোন টাকা পাওয়া গেল না। আমার বইটাতে নাইন, টেন ও ইলেভেনের ত্রিকোনমিতি পুরো সিলেবাস একসঙ্গে ছিল। এর কিছুদিন পরেই কতগুলি বই বের হয়  যাতে নাইনের পুরো অঙ্কের সিলেবাস(অর্থাৎ এলজেব্রা, স্হানাঙ্ক-জ্যামিতি, ত্রিকোনমিতি ইত্যাদি)একসঙ্গে একটি বইতে পাওয়া যায়। তেমনি আলাদা বই টেন এবং আলাদা ক্লাস ইলেভেনের অঙ্কের বই প্রকাশিত হয়। ফলে নাইনের বই কেনার সময় টেন বা ইলেভেনের বই অযথা কিনে রাখতে হচ্ছে না। কাজেই আমার বই বিশেষ বিক্রি হল ন। এই সময়, ভবানীপুর মিত্র-ইনস্টিটিউশনের অঙ্কের সুপরিচিত শিক্ষক শ্রীকেশব নাগের উচ্চমাধ্যমিক অঙ্কের বই প্রকাশিত হয়। সব স্কুলে এই বইটি পাঠ্য হয়। অত্যন্ত ভাল শিক্ষক কেশব নাগ কঠিন জিনিস জলের মত সোজা করে বোঝাতে পারতেন বলে ওঁর সুনাম ছিল। বিশেষ করে সাধারণ ও মাঝারি মেধার ছাত্রদের উনি ভাল ছাত্র বানাতে পারতেন। ইতিপূর্বে মাধ্যমিকের জ্যামিতির একটি বহুল প্রচলিত নোট বই উনি লিখেছিলেন। সে বইতে বিপুল সংখ্যক শক্ত শক্ত একস্ট্রা কষে দেওয়া ছিল। উচ্চমাধ্যমিকের বইগুলি ও একই স্টাইলে লিখলেন। প্রত্যেক অধ্যায় বিপুল সংখ্যক অঙ্ক কষে দেওয়া এবং অনুরূপ একাধিক অঙ্ক কষতে প্রশ্নমালায় দেওয়া রয়েছে। অঙ্ক কষার জন্য ছাত্রদের আর চিন্তা ভাবনা করতে হত না, কষা অঙ্কগুলো দেখে নিলেই হোত। ছাত্র ও অঙ্কের শিক্ষকদের মধ্যে বইগুলি বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্কুলে স্কুলে বইগুলো সহজেই পাঠ্যপুস্তকের স্বীকৃতি পেল। ক্লাসরুমে শিক্ষকদের পড়ানো কিছুটা যেন লাঘব হোল।   অনভ্যাসে ছাত্রছাত্রিদের চিন্তা করার ক্ষমতা হ্রাস পেতে লাগল, বিশেষ করে ক্ষতি হল সেরামেধার বাঙ্গালী ছাত্রছাত্রিদের। বাণিজ্যিক কারণে বি.এ.,বি.এস.সি. পর্যায়ে ও বাংলায় এই স্টাইলে বই লেখা হতে লাগল। এই সব বিবেচনা করলে মনে হয় কেশব নাগের উচ্চমাধ্যমিক অঙ্কের বইগুলি সেরা বাঙ্গালী ছাত্রছাত্রিদের উপকারের চেয়ে অপকারই করেছে বেশি।

আমার ত্রিকোনমিতি বই যখন বিশেষ চলছে না, তখন বইটার ইংরেজি অনুবাদের প্রস্তাব পেলাম। কলেজগুলিতে  PreUniversity পর্যায়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হয়। তাই ইংরেজিতে PreUniversity Trigonometry  লিখলাম। এটি একটু বেশি চলে। আমি টাকা পেলাম ৫০০।-, আমার জাহাজ ভাড়ায় কাজে লাগল।

পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করতে গিয়ে দেখলাম, আমি যে ভারতের নাগরিক তা প্রমাণ করতে হবে। আমার জন্মস্হান তদানিন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের যশোর জেলার ছোট টাউন নড়াইলে। ছোটবেলা কেটেছে ময়মনসিংহ সহরে। সেখানকার আনন্দমোহন কলেজে বাবা সংস্কৃত ও বাংলা পড়াতেন। ১৯৫০ সালের রায়টের সময় উদ্বাস্তু হয়ে আমরা একবস্ত্রে কলকাতা চলে আসি ২৩শে মার্চ,১৯৫০ সালে। কাজেই, আমাকে ভারতের নাগরিক হতে হবে রেজিস্ট্রেশন করে। জি.পি.ও.র পাশে লাল বাড়িতে একাধিক বার ছুটোছুটি করে শেষপর্যন্ত রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট লাভ করি। তারপর ও পাসপোর্টের জন্য প্রচুর ছুটোছুটি করতে হয়েছে।

এই রকম সময়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের State Scholarship এর বিজ্ঞাপন বের হয়। ভাবলাম একটা ইন্টারভিউ দিলে ক্ষতি কি। বিলেতে গিয়ে গবেষণা করে তিন বছর পরে ফিরে এসে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করতে হবে। তিন বছর অধ্যাপনা করার সম্মতিসূচক একটি বন্ডে সই করতে হবে। যাতায়াতের প্লেন ভারা দেবে, আনুষঙ্গিক খরচ ও মিলবে। মাসোহারা যা দেবে তাতে ভালই চলে যাবে বলছে, তবে টাকায় পরিবর্তন করলে জার্মানিতে যে টাকা পাব সেটা কিছুটা বেশি। আমার Acceptance জানাতে ও বিশদ  জানতে একদিন রাইটারর্স বিল্ডিং এ Deputy Secretary Education, Mr. B.P. Niyogi র সঙ্গে দেখা করলাম। ইনি আমার হাবলি কাকা। ঠাকুর্দা রামপ্রসাদ নিয়োগীর সবচেয়ে ছোট ভাই অবনীপ্রসাদ নিয়োগীর বড় ছেলে, ব্রজেন্দ্রপ্রসাদ। সরকারের তরফে এঁরই উপর State Scholarship এর সমস্ত দায়িত্ব।

এইবার সুরু হল দ্বিধা ও চিন্তা ভাবনা। কি করব, কোনটাকে নেব?    ক্যেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি লিখে জানলাম ওখানে Ph.D. করার আগে ৯/১০ মাসের একটা ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হতে হবে। পরীক্ষায় ভাল করলেই কেবল Ph.D Registration করা যাবে। Oxford University র নিয়ম একই রকমের। আমার পছন্দের বিষয় Transonic Flow বিষয়ে গবেষণায় নাম করা অধ্যাপক তখন

বিলেতের University গুলোতে একজন ও ছিলেন না।  তাই জার্মানিতে অধ্যাপক অসভাটিচের কাছে যাবার ইচ্ছে ছাড়তে পারছিলাম না। Transonic Flow বিষয়ের অনেকখানি ওঁরই সৃষ্টি। যাই হোক, যাত্রার প্রস্তুতি চলতে থাকল। বন্ধু বান্ধবরা আমাকে দেখিয়ে বলতে লাগল, এই একজন দুপকেটে দুটো বিদেশ যাবার Scholarshরip নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেশ ফুর্তিতেই ছিলাম।

ইতিমধ্যে এক অপ্রত্যাশিত অঘটন ঘটল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আমার জার্মানি যাবার ছুটি নামঞ্জুর করলেন। J.U. Governing Body President ডঃ বিধান চন্দ্র রায় নিজে আপত্তি করেন। বলেন, “এই সব ছেলেরা বিদেশে যায়, আর ফেরে না। এদের পেছনে অর্থের অপচয় করার দরকার নেই।“ আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। আমার রওনা হবার দিন ঠিক হয়ে গেছে, আখেন সহরে আমার থাকার জন্য ঘর বুক করা হয়ে গেছে, গরম স্যুট বানানো হয়েছে, দুজোড়া জুতো কিনেছি, সস্তার চাইনিজ জুতো, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট থেকে, বলতে গেলে সব প্রস্তুতি শেষ, এমন সময় এই দুঃসংবাদ। State Scholarship তখন পর্যন্ত ভাগ্যিস ছেড়ে দিইনি। তেমন হলে State Scholarship ই নিতে হবে।

অবশ্য J.U. তে Study Leave এর জন্য দরখাস্ত করার সময় Service Rule দেখেছিলাম, অন্তত তিন বছর চাকরি হলেই ছুটির যোগ্য বিবেচিত হতে পারে। ১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার চাকরি হয় মাত্র আড়াই বছর।  ১৯৬১র জুলাই মাসে আমার চাকরির তিন বছর পূর্ণ হবে। তখন হয়ত ছুটি পেলেও পেতে পারি। অধ্যাপক অসভাটিচকে বিস্তারিত খুলে জানলাম এবং জানতে চাইলাম আমি মাস ছয়েক পরে যেতে পারি কিনা?

উত্তরে উনি সঙ্গে সঙ্গে জানালেন যখন ছুটি পাব আমার সুবিধেমত যেন আসি। আমার মাথা থেকে একটা বড় দুঃশ্চিন্তা দূর হল। State Scholarship গ্রহণ করছি না যথাযোগ্য স্হানে জানিয়ে দিলাম। ছয় মাস সময় পাওয়ায় টাকা পয়সার টানাটানি একটু কমল।

সর্বাগ্রে গেলাম হরি সিং ট্র্যাভেল এজেন্টের অফিসে, পুরোনো Booking cancel করে ১৯৬১ সালের জুলাই মাসের বুকিং চাইলাম।। Lloyed Triestino জাহাজে ৯ই বম্বে থেকে ছেড়ে ইটালির জেনোয়া বন্দরে পৌঁছবে ২৩শে জুলাই। সেখান থেকে ট্রেণে, ইটালি-হলান্ড এক্সপ্রেসে ইটালি-সুইজারল্যান্ড হয়ে জার্মানির কোলোন স্টেশন। সেখান থেকে অন্য ট্রেণে ৭০ কিলোমটার দূরে আখেন স্টেশনে যেতে হবে। কলকাতা থেকে রওনা হব ৫ই জুলাই বম্বে মেলে। ৭ ও ৮ বম্বেতে ভিক্টোরিয়া টারমিনাস স্টেশনের কাছে কোন একটা হোটেলে উঠব। জাহজ ছাড়ার আগের দিন ওদের অফিসে দেখা করতে হবে, confirmation ও অন্য কিছু কাজের জন্য। আশা করি J.U. এবার ছুটি দিতে আপত্তি করবে না।

এইবার পূর্ণ উদ্যমে সুরু হল যাত্রার প্রস্তুতি। একটু লেখাপড়া  ও সুরু করলাম। জার্মান ভাষাটা আর একটু ভাল করে শেখার উদ্দেশ্যে জার্মান ভাষায় Transonic Flow বিষয়ে  Guderly এর লেখা একখানা বই অনুবাদ করা সুরু করলাম। একটা বড় German-English Dictionary ও কিনলাম। জার্মানি যাচ্ছি শুনে চেনাজানা আত্মীয় স্বজনরা নানারকম উপদেশ দিতে সুরু করলেন। বলতে গেলে উপদেশের বন্যা। দুএক জন আবার তাদের চেনাজানার মধ্যে আখেন বা ধারে কাছে গেছেন বা আছেন এমন ছেলেদের নাম ঠিকানা যোগাড় করে আমায় দিলেন। এমন একজনের সঙ্গে পরে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। জার্মানিতে প্রবল ঠান্ডা, আমি আবার বেজায় শীতকাতুড়ে| কি কি গরম জামাকাপড় সঙ্গে নেব, বই খাতাপত্রই বা কি কি নেব, এই সব চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। টাকাপয়সা যা দেবে তাতে চলবে তো? জানলাম, জার্মানরা ভাত খায় না, আলু খায়| তাতে আবার পেট ভরবে তো? Max Mueller ভবনে জার্মান শেখার সময় এক জার্মান মহিলা একদিন পড়াতে এসে আমাদের আদব কায়দা শেখালেন | যাই হোক, ভাবতে লাগলাম তাহলে সত্যি জা্র্মানি যাচ্ছি| J.U. তে নতুন করে ছুটির দরখাস্ত করলাম| ছুটি মঞ্জুর ও হয়ে গেল, দুবছরের Study Leave, half pay পাওয়া যাবে| তিন/ছয় মাস অন্তর কাজের অগ্রগতির রিপোর্ট নিয়মিত J.U. তে পাঠাতে হবে| এবার পূর্ণ উদ্যমে সুরু হল প্রস্তুতি| বন্ধুবান্ধবরা farewell জানাতে সুরু করলেন | আমি I.Sc. বেনারসে Anglo-Bengali College এ পড়ি | সেখানকার ঘনিষ্ঠ চার বন্ধু, তরুন, সমরেন, কেশব ও রঞ্জু একদিন সকালে বসুশ্রী কফি-হাউসে বিদায় সম্বর্ধনা জানাল| সঙ্গে তিন চারটে বাংলা বই,-একটা সঞ্চয়িতা, আর একটা হাসির গল্পের সঙ্কলন, আরও দুটো বই| বইগুলো আমি আখেনে নিয়ে যাই| এগুলো ছিল  আখেনে আমার একাকী জীবনের সঙ্গী| সঞ্চয়িতা এখনও আমার কাছে আছে এবং সময় করে আমি পড়ি|

দেখতে দেখতে আমার রওনা হবার দিন, ৫ই জুলাই,১৯৬১ এসে গেল| যথাসর্বস্ব দুটো স্যুটকেসে এবং একটা কিট-ব্যাগে ভরে হাওড়া স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম| ট্রেণ ছাড়বে রাত ৯টা নাগাদ| হাওড়ায় বিদায় জানাতে আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব অনেকে এসেছিলেন| বৌদি, দুই ভাইঝি, ঝুমু(৯ বছর) ও রূপু(৬ বছর) কে নিয়ে এসেছিলেন| রূপু বলল, ঐদিন বৌদি কই মাছের ঝোল রেঁধেছিলেন| একটা চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, বিছানা নেব, না নেব না? কেউ কেউ বললেন, বিছানা নেবার দরকার নেই| তবু আমার সন্দেহ যাচ্ছিল না| অন্তত ট্রেণের জন্য ছোট একটা বালিস আর চাদর নিলাম| এতদিন কাজেকর্মে ব্যস্ত ছিলাম, ট্রেণ ছাড়ার পর নিজের একাকীত্ব অনুভব করলাম, কোন অজানা অপরিচিত জগতের দিকে চলেছি?

পরের দিন সকাল ১০টা নাগাদ ট্রেন পৌঁছল মোগলসরায় স্টেশনে| সেখানে আমার মেজদার সঙ্গে মা এলেন দেখা করতে| মা এবং মেজদা থাকতেন বেনারসে| চিকিৎসা করাতে বাবা কলকাতায় ছিলেন| বেনারস থেকে মোগলসরায় দশ বারো মাইল দূরে, বাসে করে ওঁরা এসেছেন| ছেলে বহু দূর চলে যাচ্ছে| তাকে বিদায়-আশীর্বাদ না জানিয়ে কোন মা কি থাকতে পারেন? এইভাবে গুরুজনদের আশীর্বাদ, বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজনদের ঐকান্তিক ভালবাসা ও শুভেচ্ছা নিয়ে আমি এগিয়ে চললাম এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে|

বম্বে ভিক্টোরিয়া টারমিনাস স্টেশনে ৭ তারিখ যথাসময়ে পৌঁছলাম এবং কাছেই শান্তিনিবাস নামে এক হোটেলে উঠলাম| আমার বেনারসের বন্ধু পীযূষ গাঙ্গুলী খারে থাকত| ওকে সব জানিয়েছিলাম| ওর মামারা হলেন সিনেমা জগতে বিখ্যাত  শশধর মুখার্জী, সুধীর মুখার্জী, রাম মুখার্জী| ও এসে ওদের বাড়ি নিয়ে গেল| ওর ছোটমামার বাড়ি খারে| সেখানে তখন ওর দিদিমা ছিলেন| বেনারসে গণেষ মহল্লায় পীযূষদের বাড়ি গিয়ে উনি মাঝে মাঝে অনেকদিন থাকতেন| উনি আমাকে চিনতেন| বেশ জাঁদরেল মহিলা| আমি তখন বেশ রোগা ছিলাম| উনি একদিন আমাকে বলেন, “এত রোগা তুমি, তুমি তো কুলিগিরির চাকরি ও পাবে না| শরীর ভাল কর|” সৌভাগ্যের বিষয় চাকরির জন্য আমাকে কখনো দুঃশ্চিন্তা করতে হয় নি| যাই হোক, উনি পরের দিন সন্ধায় খেতে বললেন| আদর কোরে  সামনে বসিয়ে প্রচুর খাওয়ালেন| পীযূষ আমাকে একটা সার্ট উপহার দিল| আমার জন্মদিন ভালই কাটল| পরের দিন সকাল দশটায় জাহাজে উঠতে হবে| পীযূষ আমাকে জাহাজে চড়িয়ে see-off করল। আমার সমুদ্রযাত্রা সুরু হোল, রবিবার ৯ই জুলাই ১৯৬১|

সমুদ্রযাত্রার ১৪ দিন

ধীরে ধীরে জাহজ পশ্চিম দিকে চলতে সুরু করল| যারা আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধবদের বিদায় জানাতে এসেছিলেন তাদের হাত নাড়া আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হয়ে এল| জাহাজের ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আমরা যতক্ষণ পারা যায় সেই দৃশ্য দেখতে লাগলাম| ডেকে দাঁড়িয়ে কয়েক জনের সঙ্গে আলাপ হোল| অনেকেই কম বয়স|বেশির ভাগ ই প্রথম বিদেশ যাচ্ছেন| ডঃ নন্দী বলে এক ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ হল| ইনি বিলেত যাচ্ছেন F.R.C.S. করতে| তিনি সবাইকে সাবধান করলেন জাহাজের দুলুনিতে বমি হবে| উনি অনেক Avomin tablet এনেছেন এবং সবাইকে বিলি করা সুরু করলেন| আমি অবশ্য নিলাম না| ডেকে যারা দাঁড়িয়েছিলেন আস্তে আস্তে তারাও যে যার কাজে গেলেন| আমি ও আমার কেবিনে ঢুকলাম|

আমাদের কেবিনে দুটো ডবল বাঙ্ক বেড, মোট চারজনের শোবার বা থাকার ব্যবস্হা|  Attached bath. পুরো জাহাজ টা air-conditioned. কেবিনের সহযাত্রিদের সঙ্গে আলাপ হল| চারজনই কাছাকাছি বয়সের| চার জনের মধ্যে দুজন বাঙ্গালি, একজন মারাঠী, পুণের বাসিন্দা, স্টুটগার্ট যাবে ইন্জিনিয়ারিং পড়তে আর চতুর্থ জন মেঘালয় থেকে এসেছে, বিলেত যাবে ডাক্তারি পড়তে| দ্বিতীয় বাঙ্গালি, ছোটখাট চেহারা, উপাধি পাইন, জার্মানির এক ফ্যাক্টরিতে অ্যাপ্রেন্টিস  রূপে কাজে যোগ দেবে|

এরা কয়েকজন ছুটোছুটি করে জাহজটা ঘুরে দেখতে লাগল, জাহাজের গলি ঘুঁজি আবিষ্কার করতে লাগল, নতুন বন্ধু খুঁজে চলল| সেসব কিছু না করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি একটু শুলাম আমার জন্য নির্দিষ্ট নীচের বাঙ্ক-বেডের  শয্যায়| বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ধবধবে সাদা নরম বিছানায়| আরামই লাগছে শুতে| আকাশ পাতাল ভেবে চললাম| সম্পূর্ণ অজানা দেশে, অজানা পরিবেশে অজানা পথে চলেছি, “কিসের অণ্বেষণে”? লক্ষ্য গবেষণা করা, Ph.D. করা| অজানা অচেনা গাইড| তিনি আবার কেমন মানুষ কে জানে? চিঠিপত্র পড়ে তো ভাল মানুষই মনে হয়েছে| চিঠিপত্র যেমন ফেরত ডাকে উত্তর দিয়েছেন, যেমন আন্তরিক আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তাতে তো প্রত্যেকবার আমি অভিভূত হয়েছি| পরে যখন সাক্ষাৎ হয়েছে এবং দীর্ঘ চার বছর তাঁকে কাছে থেকে ঘনিষ্টভাবে জানার সুযোগ হয়েছে তখনই মনে হয়েছে এত বড় মাপের মানুষ আমি খুব কম দেখেছি| আর এক জন বড় মাপের মানুষের কথা মনে হয়েছে, তিনি অধ্যাপক এন.আর.সেন| ভাবলাম, বড় মাপের মানুষ না হলে বড় বিজ্ঞানী  হওয়া যায় না! সারা জীবন আর একজন বড় মাপের মানুষের সান্নিধ্য ও অকুন্ঠ আশীর্বাদ লাভ করে ধন্য হয়েছি, তিনি আমার পিতৃদেব সুরেন্দ্র প্রসাদ নিয়োগী, সারা জীবন দুঃখ কষ্টের মধ্যেও যাঁর মুখের  প্রাণখোলা হাসিটি কখনো মিলিয়ে যায় নি|

শুয়ে শুয়ে সাত পাঁচ ভেবে চলেছি| আমাদের জাহাজের নাম S.S.Victoria. শুয়ে শুয়ে টের পাচ্ছি ভিক্টোরিয়ার দুলুনি যেন বেড়ে চলেছে| পাইন আর শঙ্কর(পুণের থেকে আসা ছেলেটির নাম ভুলে গেছি| ওর নাম মনে হয় শঙ্কর) দৌড়তে দৌড়তে কবিনে ঢুকল, আর বলল লাঞ্চের সময় হয়ে এল, প্রথম ব্যাচ সাড়ে ১১টায়, পরের ব্যাচ সাড়ে ১২টায়| আমার ক্ষিধে পায় নি| পরের ব্যাচে খাব| কি দেয় দেখবেন, beef দেবে না তো? আমরা কেউ ই বিফ খাব না| ওরা বলল, ভিক্টোরিয়ার দুলুনি বেশ বেড়ে গেছে, একটু যেন গা গুলোচ্ছে| বলতে বলতে ওরা খেতে ডাইনিং হলে গেল| আমি শুয়েই থাকলাম|

আষাঢ মাস, আরব সাগরে ঘোর বর্ষা চলেছে| বড় বড় ঢেউ আসছে, আর জাহাজের দুলুনি যেন বেড়েই চলেছে| জাহাজটা টলছে, “একবার ডান দিকে তারপর বাঁ দিকে, তারপর কে যেন ঠেলে উপরে তুলছে এবং মুহূর্তের মধ্যে গভীর নীচে ফেলে দিচ্ছে”, – এইরকম কোরে এগিয়ে চলেছে, শুয়ে শুয়ে জাহাজের গতি লক্ষ্য করছিলাম| নীচের দিকে যেই নামছে অমনি গা গুলোচ্ছে| বিফ খাব না বলতে বলতে পাইন আর শঙ্কর উপরের তলায় ডাইনিং হলের দিকে এগোল| আমি শুয়ে শুয়েই আকাশ পাতাল ভেবে চলেছি| কিছুক্ষণ পরে ওরা দৌড়তে দৌড়তে কেবিনে এসে ঢুকল, ঢুকেই বাথরুমের দিকে দৌঁড়ল| বেসিন পর্যন্ত পৌঁছনর আগেই হড়হড় কোরে দুজনের বমি| মুখ ধুয়ে একটু জল খেয়েই আবার বমি| ওদের বমি কোরতে দেখে আমি একটু উদ্বিগ্ন হলাম, যদিও আমি কোনো অসুবিধে বোধ করছিলাম না| শুয়ে ছিলাম, তার উপর খালি পেট, তাই হয়ত গা গুলোচ্ছিল না| আমি ডাইনিং হলের দিকে চললাম| ওরা চেঁচাল, সাবধানে খাবেন, সব বিফ!
আমাদের জাহাজটিতে ৫০০ যাত্রীর যাবার ব্যবস্হা আছে| বেশ বড় সাজানো গোছানো ডাইনিং হল| কিন্তু একি, মাত্র সামান্য কজন খেতে এসেছে| লাক্সারি জাহাজ, পাঁচ কোর্সের লাঞ্চ ডিনার| শুনলাম, বিলেতে নাকি রাজারাণিরাই কেবল পাঁচ কোর্সের খাবার খায়| কপাল গুণে আমিও সেই সমাদর লাভ করছি| প্রথম আইটেম স্টার্টার: অনেক কিছুর মধ্যে, যার বেশির ভাগই দুর্বোধ্য, oil hering নিলাম,- অন্তত হেরিং নাম টা তো চেনা| মুখে দিতেই বমি পেল| পরে জেনেছি, কাঁচা হেরিং মাছ অলিভ অয়েলে কয়েকমাস ভিজিয়ে রেখে এটি তৈরি হয়েছে| যাই হোক, main course  এ হামবুর্গার নিলাম, কিমা-পাউরুটি দিয়ে তৈরি| স্যালাড ও অন্যান্য খাবার ছিল সঙ্গে| পুডিং, আইসক্রিম ইত্যাদি দিয়ে শেষ করে, সবে জল খেয়ে মুখ ধুতে পাশেই বাথরুমে যাচ্ছি, কিন্তু তার আগেই হড়হড় করে করিডরে সব বমি হয়ে গেল, সামলাতে পারলাম না| মুখ ধুয়ে নিজের কেবিনে ফিরব, পথে আবার বমি| অসহ্য কষ্ট হচ্ছে| আকন্ঠ জল পিপাসা, কিন্তু জল খেলেই বমি হয়ে যাচ্ছে| সোজা কেবিনে ঢুকে সটান বিছানায়| পরে দেখলাম, সমস্ত প্যাসেঞ্জার বমি করছে, যত্রতত্র| চুপচাপ শুয়ে থাকলাম, কারু সঙ্গে কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না| প্রবল পিপাসা, কিন্তু জল খাওয়া যাচ্ছে না, খেলেই বমি| আমার কেবিন-বন্ধুরা ঘিরে ধরে জানতে চাইল কি খেলাম| হামবুর্গার শুনতেই পাইন বলে উঠল,”নিয়োগীদা, আপনার তো জাত গেল!” আমি একটু আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম কি ভাবে? ওরা সমস্বরে জানাল, হামবুর্গার বিফের কিমা দিয়ে তৈরি| এইভাবে, না জেনে আমি বিফ খেলাম| স্হির করলাম, এর পর থেকে আর কিসের মাংস খাচ্ছি জানতে চাইব না| কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল, চুপ চাপ মড়ার মত পড়ে রইলাম|

সন্ধ্যাবেলা steward কেবিনে এল| ইংরেজি ভাল বলতে পারে না| ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে যা বলল তা হল, শুয়ে থাকলে সি-সিকনেস যাবে না| ডেকে যাও, সমুদ্র দেখ, দৌড়াদৌড়ি কর| আর একদম জল খাবে না| আমরা কেউই রাত্রে কিছু খাব না| ও বলল, না খেলে শরীর আরও খারাপ লাগবে, আমি তোমাদের জন্য টমেটো-স্যান্ডউইচ নিয়ে আসচি,

আর শুকনো ব্রেড, তাই পেট ভরে খাও, দেখবে সি-সকনেস চলে গেছে| যাই হোক, অতিকষ্টে একখানা স্যান্ডউইচ খেয়ে মড়ার মত পড়ে থাকলাম| ঘুমিয়ে পড়লাম| ঘুম ভাঙ্গল খুব ভোরে| ঘড়িতে দেখি পাঁচটা| প্যান্ট পোরে ডেকে গেলাম| ডেকে আমি ছাড়া এক সাহেব মেম

ডেক চেয়ারে আধশোয়া অবস্হায় রোদ পোহাচ্ছে| আমি রেলিং ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম, সমুদ্রের ঢেউ দেখতে থাকলাম| চারপাশে অসীম সমুদ্র, আর অনুভব করছি জাহাজের দুলুনি,-এছাড়া দুএকটা সামুদ্রিক পাখি মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে| বিরাট বিরাট ঢেউ আসছে, জাহাজটা যেন একটা খেলনা, সব কিছু ওলট পালট করে দিয়ে যাচ্ছে| মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের “নিরুদ্দেশ যাত্রা” কবিতা| দেখতে দেখতে আশ্চর্য ব্যাপার, আমার গা গোলানো ভাবটা যেন নেই! একাই ডাইনিং হলে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করলাম| খুব সাবধানে চা খেলাম, এই বুঝি গা গোলানো শুরু হয়ে গেল| কৈ, নাতো, গা গুলোচ্ছে না! একটু পরে জানতে পারলাম, পুরো জাহাজে বমি করছে না এমন যাত্রির সংখ্যা নিতান্তই নগন্য|  ডেকে দাঁড়িয়ে ২/৩ ঘন্টা সমুদ্রের ঢেউ দেখাটা সি-সিকনেসের অসাধারণ ভাল ওষুধ| ফিরে এসে দেখলাম, আমার কেবিনের বন্ধুরা শয্যাগতই রয়েছেন, শয্যা ত্যাগ করতে পারছে না| এমন কি ডঃ নন্দী, যিনি এফ.আর.সি.এস. করতে বিলেত যাচ্ছেন এবং যাত্রা সুরুর দিন যিনি অকাতরে সবাইকে Avomin tablet বিলি করেছেন, তিনি নিজেও শয্যাগত| এই অবস্হায় জাহাজের ক্যাপ্টেন সিদ্ধান্ত নিলেন, করাচি বন্দরে জাহাজের Emergency landing করার| তিন ঘন্টার জন্য ডাঙ্গায় নামা যাবে| জাহাজ থেকে নেমে, করাচির বন্দর এলাকায় রাস্তায় হাঁটলাম| তখন সন্ধ্যাবেলা| কাছেই একটা রেস্তোরায় চিকেন-রাইস ইত্যাদি খেলাম| ভাল রান্না, তবে বেশ rich. আমার সঙ্গের ভারতীয় মুদ্রা, জাহাজে ওঠার সময় বিদেশি মুদ্রায় পরিবর্তনের পর, কিছু অবশিষ্ট ছিল| সেই ভারতীয় মুদ্রায় রেস্তোরার বিল মেটালাম| ভারতীয় মুদ্রা গ্রহণ করতে এরা কোন আপত্তি করল না| সর্বসাকুল্যে আট পাউন্ড বিদেশি মুদ্রা সঙ্গে নিতে দিয়েছে, যকের ধনের মত তা আগলে রেখেছি| কিছুটা ঘুরে ফিরে জাহাজে উঠলাম| আশ্চর্য ব্যাপার, পরের দিন বড় একটা কেউ বমি করল না, ডাইনিং হল প্রায় ভর্তি| অনেক বেশি যাত্রি ডাইনিং হলে আহার করলেন| পরের দিন এডেনে পৌঁছলাম| ফ্রি-পোর্ট এডেনে জিনিসপত্র খুব সস্তা| কলকাতা থেকে যে টাকা সঙ্গে এনেছিলাম, করাচিতে রেস্তোরার বিল মেটানোর পর সামান্য কিছু তখনও অবশিষ্ট ছিল| একটা দোকানে দেখলাম Parker 51 পেন 48 টাকায়(ভারতীয় মুদ্রায়) দিচ্ছে| দ্বিধা না কোরে কিনে ফেললাম| পেনটা অনেকদিন আমার কাছে ছিল, পেনটি দিয়ে অনেক লিখেছি| জার্মানির পর্ব শেষ করে কলকাতায় ফিরেছি ১৯৬৫ সালের অগাষ্ট মাসে| তখনও পেনটি আমার কাছে ছিল| তারপর একদিন J.U. টিচার্স রুম থেকে চুরি যায়| ব্যাগের মধ্যে ছিল পেন আর কায়রো থেকে কেনা, মিশর দেশের নানা দ্রষ্টব্য emboss করা একটা মানিব্যাগ, ১০০টাকা ছিল মানিব্যাগে| সবই চুরি যায়| যাকগে সেকথা|

এডেন বন্দর ছাড়ার পর Red Sea দিয়ে জাহাজ যাচ্ছে| মাঝে মাঝে জলের একএকটা বড় অংশ টকটকে লাল| হয়ত এজন্যই নাম Red Sea. জাহাজে বেশ কয়েক দিন হল| এখন ভালই লাগছে সমুদ্রযাত্রা| সন্ধ্যাবেলা জাহাজে নাচগানের আসর বসে, সঙ্গে পানীয়, অবশ্য আলাদা পয়সা দিয়ে কিনতে হয়| তখন “চা চা চা”-র যুগ| হিন্দি গান, “ও গোরে গোরে, ও বাকে ছোড়ে,..”- ইত্যাদি গান বাজিয়ে ইতালিয় বাজিয়েরা আসর মাতিয়ে তুললেন| অনেকে নাচতে সুরু করলেন| আমরা বসে নাচ গান দেখতে লাগলাম| ওখানে ঠান্ডা পানীয় পাওয়া যাচ্ছিল, তবে বিদেশি মুদ্রায় কিনে খেতে হবে| এমন বিলাসিতা ৮-পাউন্ড ট্র্র্যাভেলার্স চেক নিয়ে করা চলে না| কাজেই, আমরা শুকনো মুখ বসে নৃত্য-গীত উপভোগ করতাম| খরচ করার মত বাড়তি পয়সা আমদের কারুর ই ছিল না| লাঞ্চ, ডিনার, ব্রেকফাস্ট- সবই বেশ উন্নত মানের ছিল| ধীরে ধীরে আমরা খাবার এবং service তারিফ করা সুরু করলাম| আমরা রোজ রাজার হালে লাঞ্চ ডিনার করছি, আর কি চাই! এইভাবে আমরা পোর্ট-সইদে পৌঁছলাম| যাত্রিদের একটা সুযোগ দিল, এখানে নেমে, গাড়ি করে পিরামিড দেখিয়ে কায়রো পৌঁছে দেবে, কিছু অর্থের বিনিময়ে| কায়রোতে আবার জাহাজ ধরা যাবে| কোনো প্রলোভনেই আমার যৎসান্য বিদেশি মুদ্রা খরচ করব না| কাজেই আমি এ সুযোগ গ্রহণ করলাম না| সুয়েজ খালের ভিতর দিয়ে অত্যন্ত ধীরে ধীরে জাহাজ চলল| সামনে একটা পাইলট জাহাজ পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল| সুয়েজ খাল খুব সংকীর্ণ| একশো মাইল যেতে সময় নিল ২৪-ঘন্টা| কায়রো পৌঁছে কিছুক্ষণ জাহাজ দাঁড়াবে| আমরা অনেকে নেমে ঘুরে বেড়ালাম| নানারকম পসরা নিয়ে রাস্তায় আমাদের সঙ্গ নিল, কয়েকজন নাছোড়বান্দা ফেরিওয়ালা, মিসরীয় পিরামিড, মমি ইত্যাদি ছবি emboss করা মানিব্যাগ বিক্রি করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে চলেছে| নেব না বললেও পিছু ছাড়ছে না| রেহাই পাবার উদ্দেশ্যে অসম্ভব কম একটা দাম বললাম| ভারতীয় মুদ্রা নিতে হবে, তাও বললাম| সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিল| ব্যাগটি চামড়ার নয়| তবুও souvenir হিসেবে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতাম,

সাধারনত আমার পোর্টফোলিও ব্যাগের ভিতর| সেই মানিব্যাগটি একদিন চুরি হয়ে যায়, Jadavpur University, Undergraduate Science Building, দোতলার teachers’ room  থেকে, -আগেই বলেছি|

কায়রো থেকে জাহাজ চলল ভূমধ্যসাগরের আশ্চর্য সুন্দর নীল জলের মধ্যে দিয়ে। ডেকে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চারপাশের মনোরম সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। যতক্ষণ পারা যায় দাঁড়িয়ে রইলাম। বহুকাল আগে এমনি নীল  জল দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিজ্ঞানি সি.ভি.রমন| কারন অনুসন্ধান করে তিনি যে তত্ত আবিষ্কার করেন, তার জন্য তিনি নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন| তত্তটি “রমন এফেক্ট” নামে বিখ্যাত|

আমাদের জাহাজ ভূমধ্যসাগরে পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলেছে, উত্তর উপকূলে বিখ্যাত রিভিয়েরা অঞ্চল| জাহাজ একটা Special Halt দিল ইটালির নেপেলস বন্দরে। এখানে নেমে আমরা পম্পেই সহর দেখতে গেলাম। এই সহরটি ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির লাভাতে সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে বহুকাল আগে। জাহাজের পরবর্তি স্টপেজ হল ইটালির জেনোয়া বন্দর। আমি এবং আরো অনেকে এখানেই জাহাজ থেকে নেমে ট্রেনে যার যার গন্তব্যস্হলের দিকে অগ্রসর হব। আমার ১৪ দিনের সমুদ্রযাত্রার এখানেই ইতি।

জেনোয়া থেকে আখেন

  • জেনোয়া বন্দরে পৌঁছলাম ভোরে| মালপত্র নিয়ে ইটালি-হল্যান্ড এক্সপ্রেস নামক ট্রেন ধরলাম| কলকাতা থেকে ট্র্যাভেল এজেন্ট প্রয়জনীয় Visa র ব্যবস্হা ও একটা  ticket advice দিয়ে দিয়েছিল| স্টেশনে গিয়ে সেটা পাল্টে টিকিট নিলাম এবং খাওয়া দাওয়া সেরে ট্রেনে উঠলাম| ট্রেন ছাড়ল ১১টা নাগাদ| বেশ দ্রুতগতির ট্রেন| ইটালি অতিক্রম করে সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালা ভেদ করে ট্রেন এগিয়ে চলল সবুজ গাছে ঘেরা পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে| কখনো উঁচু পাহাড়, কখনো বা সবুজ উপত্যকা দিয়ে| বর্ষাকাল, মেঘ ভেসে যাচ্ছে| ছোট ছোট ছবির মত গ্রাম অতিক্রম করে এগিয়ে চললাম| একের পর এক গ্রাম সহর অতিক্রম করে ট্রেন চলেছে| অতি মনোরম দৃশ্য| সন্ধ্যা হয়ে রাত্রি হল| ট্রেনে বসে বসেই ঘুমিয়ে নিলাম| জার্মানির আল্পস পর্বতমালা দিয়ে ট্রেন চলল| এমনি করে পরের দিন ভোরে, 24 জুলাই, ট্রেন পৌঁছল কোলোন স্টেশনে| এখানে নেমে আমাকে অন্য একটা লোকাল ট্রেন ধরে আখেন স্টেশনে যেতে হবে| ঘন্টা খানেকের দূরত্ব|
  • মালপত্র নিয়ে একটা ট্রেনে উঠলাম| খালি দেখে একটা কামরায় ঢুকে বসলাম| একটু পরে চেকার এসে বলল, আপনি ফার্স্টক্লাসে উঠেছেন| পাশের কামরা দেখিয়ে দিল| মোটামুটি ভর্তি একটা কামরা| মালপত্র নিয়ে সেখানে গেলাম, বসার জায়গা ও পেলাম|
  • আমার দুটো স্যুটকেশ বেশ ভারি, আর একটা কিটব্যাগ| মালপত্র উপরের বাঙ্কে রাখলাম| বছর ত্রিশের এক ভদ্রলোক, মনে হল দক্ষিণ ভারতীয়, সাহায্য করলেন| তিনি সহযাত্রিদের সঙ্গে জার্মান ভাষায় অনর্গল কথা বলে চলেছেন| আমি তার একবর্ণও বুঝতে পারছি না| পরে জানলাম, ভদ্রলোকটি ভারতীয়, তামিল, নাম বললেন সিমহান, সম্ভবত নরসিমহানের সংক্ষিপ্ত রূপ| বেশ আলাপ জমল ইংরেজিতে| জানলাম উনি T.H.(Technische Hochschule) Aachen, Aerodynamische Institute এর Prof. A. Naumann এর Assistant. থাকেন কোলোনে, সেখান থেকেই যাতায়াত করেন| ওর স্ত্রী জার্মান| দীর্ঘদিন জার্মানি তে রয়েছেন| আমি যে Institute এ যাব, সেটির নাম, DVL Institut fuer Theoretische Gasdynamik, স্টেশন থেকে হেঁটে পাঁচ মিনিটের রাস্তা| আখেন স্টেশনে আমরা নামলাম| আখেনের মাটিতে প্রথম পা রাখলাম| তারিখটা 24th July, 1961, সোমবার|.

আখেনে চার বছর

এইভাবে সুরু হোল জার্মানিতে আমার গবেষক-জীবন|

আখেনে প্রথম দিন

আখেন রেলস্টেশনে নেমে মালপত্র নিয়ে আমার গন্তব্য Institut এর দিকে হাঁটা দিলাম| সিমহানও আমার সঙ্গে  সঙ্গে চললেন, মালপত্র নিতে সাহায্য করলেন| ইনস্টিটিউটের কাছে এসে বললেন, এত সকালে কেউ আসবেনা| চল আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে আসি| স্যুটকেশ গুলো Institute এর পাশের ল্যাম্পপোষ্টের কাছে রেখে দিতে বললেন| আমি ইতঃস্তত করছি দেখে বললেন, ভয় নেই চুরি হবে না| কিছুটা দূরে, কাউফ-হোফ নামক Departmental Store এ ঢুকে ব্রেকফাস্ট করলাম| খাবার অর্ডার করলেন সিমহান, পুরো জার্মান ভাষায়| খাওয়া হয়ে গেলে উনি ওর অংশ এবং আমি আমার অংশের দাম দিলাম| ফিরে এসে আমার গন্তব্য Institute(Institut fuer Theoretische Gasdynamik) এ মালপত্র নিয়ে গেলাম| প্রবেশদ্বার দোতলায়| প্রথমবার কলিং বেল বাজাতে কেউ খুলল না| দ্বিতীয়বার বেল বাজাতে এক ভদ্রলোক এসে দরজা খুলে দিলেন| ভাবছিলাম কোন watchman, দারোয়ান বা দ্বাররক্ষক দরজা খুলবে| পরে জেনেছি, ভদ্রলোক Dr Fiebig একজন Research Associate(Wissenschaftliche Mitarbeiter). কিছুদিন পরে, Bochum সহরে নতুন University স্হাপিত হলে ইনি সেখানকার Fluid Dynamics  Institute এর Professor and Director   পদে যোগ দেন| জার্মানিতে ঝি-চাকর, কুলি বা দারোয়ান কোথাও নেই|

Institut এর ভিতরে প্রবেশ করলাম| ফ্রলাইন স্টেগারহ্যুটে এলেন| ভদ্রমহিলা Prof Oswatitsch এবং Institut এর র Secretary. সিমহান তাকে জার্মান ভাষায় কি বলে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন| ভদ্রমহিলা আমাকে আমার বসার যায়গা দেখিয়ে দিলেন| দোতলায় লাইব্রেরিতে আমার বসার স্হান| ভদ্রমহিলা কিছুটা ইংরেজি বলতে পারেন| উনি জানালেন অধ্যাপক অসভাটিচ(Prof Oswatitsch) এখন আখেনে নেই| উনি ভিয়েনাতে রয়েছেন| ভিয়েনার Technical University তে উনি Institut fuer Stroemungslehre এর Director and Professor, অর্থাৎ উনি একসঙ্গে দুজায়গায় দুটো Institut এর Director. মোটামুটি দুমাস অন্তর দুসপ্তাহের জন্য উনি আখেনে আসন| রাত্রে ঐ লাইব্রেরী ঘরেই থাকেন| ঘরে একটা folding খাট রয়েছে, বাইরে থেকে বোঝা যায় না| আমার সম্বন্ধে ইতিকর্তব্য উনি শ্রীরুয়েসকে বলে গেছেন| আর অধ্যাপক অসভাটিচের অনুপস্হিতিতে Institute এর কাজকর্ম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন শ্রীশোয়ার্ৎচ্ছেনবার্গার, Asst. Director. আস্তে আস্তে সকলের সঙ্গেই আলাপ পরিচয় হল| Institute টি ছোট, মাত্র 12জন scientist আছেন| এদের মধ্যে অনেকেই আছেন  Wissenschaftlische Mitarbeiter অর্থাৎ Research associate পদে| সকলেই পুরুষ এবং বয়স তিরিশের কাছাকাছি| আর আছে তিন চারজন মেয়ে, Computational assistant, একজন draftsman, ছবি আঁকেন বা Computer program করেন, আর আছে একটা মেন ফ্রেম Digital computer, এবং এটি দেখাশোনা করেন দুজন, তাদের মধ্যে একজন শ্রীকুরাও, বিজ্ঞানী অন্যজন শ্রী ভিঙ্কলার টেকনিশিয়ান|  

গত ডিসেম্বর মাসে আমার এখানে আসার কথা ছিল| তখন আমার জন্য একটা ঘর ভাড়া করা হয়েছিল| সেটি cancel করতে অসুবিধে হয়েছে, টাকা দিতে হয়েছে| তাই এবার আর আমার থাকার জন্য কোন ঘর book করা হয় নি| শ্রীরুয়েস যে বাড়িতে থাকেন, সেটি পাঁচতলা একটা ফ্ল্যাট বাড়ি, বেশিরভাগই One-room flat. এই বাড়িতেই একটা ফ্ল্যাট পাওয়া যেতে পারে| বাড়িটা T.H.(Technische Hochschule)Aachen এর বেশ কাছে, হেঁটে মিনিট দশেক লাগে| আমাদের Institute থেকেও হেঁটে দশ বারো মিনিট লাগে| সন্ধ্যাবেলা Institute working hours এর পর রুয়েস আমাকে নিয়ে যাবে| ওখানে একটা ঘর পাওয়া যাবে| আমার পড়াশুনা ও গবেষণা দেখার দায়িত্ব অধ্যাপক অসভাটিচ রুয়েসকে দিয়ে গেছেন|

শ্রীরুয়েসের সঙ্গে পরিচয় হোল| আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড় হবেন| একটু বেঁটে, স্বাস্হ্য ভাল, হাত সব সময় কাঁপে, অনবরত সিগারেট খান| ইংরেজি বলতে পারেন| Physics বিষয়ে Diplom অর্থাৎ M.Tech. করার পর বছর পাঁচেক এই Institute এ গবেষণা করছেন Wissenschaftlische Mitarbeiter অর্থাৎ research associate রূপে কাজ করছেন, Ph.D. thesis প্রায় তৈরি| Transonic flow বিষয়ে একটি কাজ তিনি অর্ধেক করেছেন, বাকি অংশ অধ্যাপক অসভাটিচ আমাকে সম্পূর্ণ করতে বলে গেছেন| কিভাবে করতে হবে তাও বলে গেছেন| Seminar room এ রুয়েস আমাকে নিয়ে গেলেন এবং বিশদে সমস্যাটির ব্যাখ্যা করলেন| এবিষয়ে প্রকাশিত অন্য পূর্বতন কাজ, এবং পরবর্তি কাজের রূপরেখা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলেন| প্রয়োজনীয়  পূর্বতন গবেষণা পত্রের কপি, বই ইত্যাদি উনি আগে সংগ্রহ কোরে রেখেছিলেন তা দিয়ে দিলেন| সবগুলি কিন্তু জার্মান ভাষায় লেখা| আমি অল্পস্বল্প জার্মান পড়তে পারি ডিকসেনারির সাহায্যে| আমার টেবিলে, বসার জায়গায় ইতিমধ্যে ফ্রলাইন স্টেগারহু্টে A-4 কাগজ, কিছু রাফ কিছু বন্ড পেপার, পেন্সিল, ইরেজার, কলম, স্কেল ইত্যাদি এবং একটি slide ruler সুন্দর কোরে সাজিয়ে রেখে গেছেন| লাইব্রেরি ঘরে আমার বিপরীতে আর একটি ইয়ং, ছয় ফুটের উপর লম্বা  ছেলে বসছে, নাম জানলাম হেরম্যান রোটমান| ও Physics এর ফাইন্যাল ইয়ারের Diplom(M.Tech.) এর ছাত্র, M.Tech. thesis করতে এখানে এসেছে| বাড়ি Austria র Graz সহরে| মোটামুটি মাস ছয়েক লাগবে কাজ শেষ করতে| ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি বলে| জার্মান ওর মাতৃভাষা| রুয়েসের সঙ্গে আলোচনা করতে করতে লাঞ্চের সময় হল| একসঙ্গে খেতে যাবার জন্য কয়েকজন বিজ্ঞানি আমাদের ডাকতে এলেন| Institute working hours জানলাম, সকাল 8:00-12:45, Lunch break, 1:30-5:45,

সপ্তাহে পাঁচ দিন, শনি, রবি ছুটি, যদিও অনেক বিজ্ঞানী শনিবার অর্ধদিবস কাজ করেন| কাজের প্রয়োজনে অনেক বিজ্ঞানী আবার রাতের দিকেও Institute এ কাজ করেন| লাঞ্চে যাবার জন্য চার পাঁচজন বিজ্ঞানী আমাদের ডাকতে এলেন| এদের সঙ্গে আলাপ হল| এরা হলেন শ্রী তাইপেল, রমব্যের্গ, বার্টালমে, রোটমান প্রভৃতি| রমব্যের্গ ভাল ইংরেজি বলেন এবং ইংরেজি বলতে ভালবাসেন|  Institute এর উল্টোদিকে একটা বড় সরকারি অফিস আছে| তাদের ক্যানটিনে আমরা খেতে গেলাম| আমাদের Institute লাঞ্চ subsidise করে| এজন্য কুপন দেয়| আর কাজে যোগ দিতেই শ্রীশোয়ার্ৎছেনবের্গার  আমাকে কয়েকশো ডেমার্ক(Deutsche Mark) advance করলেন, আমি চাইবার আগেই| এঁদের প্রত্যেকের ব্যবহার অত্যন্ত ভাল| আমার কি প্রয়োজন হতে পারে ভেবে চিন্তে আগেই সব ব্যবস্হা কোরে রেখেছেন দেখছি|

জার্মানিতে প্রথম লাঞ্চ

কাজের সময় জার্মানরা অল্পই খায়| প্রকৃতপক্ষে, এটা ছিল working lunch. কিছুটা মাংস, 70 গ্রামের বেশি মনে হল না(নিয়ম অনুযায়ী 100গ্রাম দেবার কথা), সঙ্গে দুটো খোসা ছাড়ানো সিদ্ধ মাঝারি সাইজের আলু আর একটু স্যালাড(সম্ভবত লেটুস পাতা)| 50 ফেনিগ(অর্থাৎ আধ মার্ক) বেশি দিলে Dessert পাওয়া যায়| একেক দিন একেকরকম থাকে| প্রথম দিন আমি পেলাম কম্পট,-চিনি মেশানো আপেল সিদ্ধ| খেতে ভালই লাগে| মাংসটা মূলত নুন-গোলমরিচ দিয়ে সিদ্ধ, একটু ঝোল আছে| লাঞ্চ শেষ করতে মিনিট দশ বারোর বেশি লাগল না| লক্ষ করলাম কারু পাতে খাবার পড়ে থাকল না| পরেও বহুবার দেখেছি জার্মানরা পাতে খাবার ফেলে ওঠে না| ইংরেজিতে একটা কথা আছে, Waste not, want not. ইংরেজরা বরং খাবার ফেলে, জার্মানরা কদাচ নয়|

বিল মিটিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম| রুয়েস বলল, খাবার পরে আমরা দশ মিনিট হাঁটি, তুমিও আমাদের সঙ্গে চল| কাছেই হাঁটতে গেলাম Elisen-Bruennen নামে একটা খুব সুন্দর পার্কে| পার্কের ভিতরে একটা উষ্ণ প্রস্রবন আছে, চারপাশে হাঁটার রাস্তা, দুধারে ফুলের গাছ, নানারকম ফুল ফুটে রয়েছে| বিভিন্ন রোগ সারে এই ফোয়ারার জলে, তাই অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এখানে আসেন| মিনিট দশেক হেঁটে আমরা Institute এ ফিরে যে যার ঘরে ঢুকলাম| ঘরে ঢুকেই হঠাৎ খুব শীত করতে লাগল| যথেষ্ট গরম জামাকাপড় পরে আছি, – উলিকট গেঞ্জি, সার্ট, সোয়েটার তার উপর গরম কোট, প্যান্টের নীচে লম্বা ড্রয়ার| আসার আগে বেনারস গিয়েছিলাম, সেখান থেকে দামি গরম কাপড় কিনে স্যুট বানিয়ে এনেছিলাম| সেটাই পোরেছিলাম সারাদিন| একটু পড়াশুনার চেষ্টা করছিলাম| যে কাজটা করব তা হল Method of characteristics এর সাহায্যে Transonic flowfield past an axisymmetric body with pointed tip  compute করা| Method of characteristics আমি মোটামুটি জানি, M.Sc. special paper এ পড়তে হয়েছিল, 2-dimensional case, এখন axisymmetric case হাতেকলমে প্রয়োগ করে result বের করতে হবে| এর জন্য প্রয়োজনীয় initial condition পাব রুয়েসের computation থেকে| রুয়েস polar coordinate ব্যবহার কোরে transonic flow equation থেকে চারটে nonlinear ordinary differential equation পায় এবং initial condition ব্যবহার কোরে,  Simultaneous Runge-Kutta method দিয়ে Institute এর Zuse-digital Computer এ numerically solve করে| এর জন্য যে Method of characteristics ব্যবহার করতে হবে সেটি অধ্যাপক অসভাটিচের সৃষ্টি| সেই পেপারের একটা reprint রুয়েস আমাকে দিয়েছে| জার্মান ভাষায় লেখা পেপারটি নিয়ে আমি বসেছি| পড়ছি এবং অর্থ বোঝার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি| কলকাতায় থাকতে আমি জার্মান ভাষায় লেখা fluid dynamics এর বই অল্পস্বল্প অনুবাদ করতে পারতাম| এখন কিন্তু সব মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে| ভীষণ ঘুম পাচ্ছে, আগের রাতে ট্রেনে বসে ভাল ঘুম হয়নি, তার উপর সারাদিন যা ধকল যাচ্ছে তা আর বলার না| একে শীত তায় ঝিমুনি, একটু যেন কাঁপুনিও হচ্ছে| উল্টোদিকে বসে রোটমান সব দেখছে| আমায় জিজ্ঞেস করল, are you alright? বললাম খুব শীত করছে| ও সঙ্গে সঙ্গে secretary কে গিয়ে বলল| ফ্রলাইন স্টেগ(সংক্ষিপ্ত রূপ) এসে সব শুনলেন| তারপর দৌড়ে গিয়ে একটা ইলেক্ট্রিক রুম হিটার নিয়ে এসে চালু করে দিলেন| তারপর বললেন, তোমার গরম জামাগুলোতে উল নেই মনে হচ্ছে| কাল রোটমান তোমাকে নিয়ে দোকানে যাবে এবং গরম জামা কাপড় কিনে দেবে| রোটমান ও আখেনে নতুন, কিন্তু ওর মাতৃভাষা জার্মান| তাই দোকানে কথাবার্তায় ওর কোন অসুবিধে হবে না|

বিকেল চারটের সময় ফ্রলাইন স্টেগ দুকাপ কফি নিয়ে এলেন| ঘরটাও আর তেমন ঠান্ডা লাগছে না| কফি খেয়ে বেশ চাঙ্গা বোধ করলাম| দেখতে দেখতে পৌনে ছয়টা বাজল| রুয়েস, তিন তলায় ওর বসার ঘর থেকে নেমে এলেন| মালপত্র নিয়ে ওর সঙ্গে  ওর বাড়ির দিকে রওনা দিলাম| স্যুটকেস দুটো বেশ ভারী, একেকটা 20/22kg কোরে, তার উপর কিট ব্যাগ, বইতে ঠাসা, কমপক্ষে দশ বারো কেজি তো হবেই| রুয়েস অবশ্য মাল বইতে আমাকে সাহায্য করলেন|

আখেন খুব পুরনো ঐতিহাসিক সহর| সহরটির পুরনো নাম Aix-la-Chapelle. Charles the Great এটিকে Holy Roman Empire এর রাজধানী রূপে প্রতিষ্ঠা করেন, খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতকে| Holy Roman Empire এর 32জন রাজা এখানকার ক্যাথিড্রালে Crowned King হয়েছেন| রুয়েসের বাড়ি, আমারও 2/3 বছরের আবাসস্হলের দিকে হেঁটে যেতে যেতে রুয়েস আমাকে সেই সব বিখ্যাত ক্যাথিড্রাল, Rathaus, Charles the Great এর স্ট্যাচু ইত্যাদি দেখাতে দেখাতে এগিয়ে চলল| অবশেষে অভীষ্ট বাড়ি, Neupforte 2 তে এসে পৌঁছলাম|   বাড়ির নীচ তলায় কেয়ার টেকার, Frau Janzen এর একটি Lebensmittel বা মুদি দোকান রয়েছে| তাকে দোকানেই পাওয়া গেল| উনি বললেন পাঁচ তলায় চিলেকোঠায় একখানা ঘর খালি আছে, দেখে আসুন পছন্দ হয় কিনা| ভাড়া 80-DMark. সপ্তাহ খানেক পরে দোতলায় একটা বড় ভাল ঘর খালি হবে, তখন সেই ঘরে ইচ্ছে করলে  shift করবেন| এই ঘরের ভাড়া 120-DMark. মালপত্র নীচে রেখে পাঁচতলায় ঘর দেখতে উঠলাম| একটা সিঙ্গল খাট পাতা, একটা আলমারি, writing table আছে| Shower আর toilette ঘরের মধ্যেই| একটা ছোট জানালা আছে| বড়ি এবং আসবাবপত্র সবই নতুন, ঝক ঝক, তক তক কোরছে| আমার তখন যা অবস্হা, যা হোক একটা থাকার আস্তানা পেলেই হয়| দ্বিধা না কোরে নিয়ে নিলাম| মালপত্র পাঁচতলার ঘরে নিয়ে গেলাম| Frau Janzen কে এক মাসের ভাড়া দিলাম| ভদ্রমহিলা পাঁচতলার ঘরে এসে দেখে গেলেন সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা| একটু পরে নীচে গিয়ে আবার উঠে এলেন, হাতে কিছু কাপড়, রুয়েসকে বললেন waesche, অর্থাৎ দুটি সাদা চাদর আর একটা লেপের ওয়াড়, লেপে ভরে নেবার জন্য| লেপের ওয়াড় ভরতে হবে দেখে আমি অত্যন্ত বিচলিত বোধ করলাম| আমি জীবনে কখনো লেপের ওয়াড় ভরিনি, কি কোরে লেপের ওয়াড় ভরবো? ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে  আমার কান্না পেয়ে গেল| বিপদে আমি সহজে ভেঙ্গে পড়ি না, কিন্তু এবার আমি হতাশ হয়ে পড়লাম| আমার অবস্হা দেখে রুয়েস বলল, It is not difficult! বলে নিজেই পটাপট ওয়াড়টা ভরে ফেলল, দুমিনিট ও লাগল না| জার্মানিতে এই আমার প্রথম শিক্ষা: কোন কাজই ছোট নয়, নিজের কাজ নিজে কর| এবার একটু বিশ্রাম, সরাদিন যা ধকল গেছে| মালপত্র টানতে টানতেই কাহিল হয়ে পরলাম| চেনাজানা কেউ বিদেশ যাচ্ছে শুনলে বলব যথাসম্ভব কম মালপত্র নিয়ে ভ্রমণ করতে|

 এই বাড়িটায় পুরো Central heating. ঠান্ডার ভয় নেই| শুলে এক্ষুণি ঘুমিয়ে পড়ব| ক্ষিদে পেয়ছে, ডিনার করা হয় নি| রুয়েস নিজের ঘরে পাউরুটি, ডিম, সসেজ ইত্যাদি খাবে বলে চলে গেছে| বলে গেছে, সামনের রাস্তা ধরে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই একটা ছোট রেস্তোরা পাবে| T.H. র ছাত্ররা ওখানে খায়, তুলনায় সস্তা| ওখানেই খেয়ে নাও| কাল থেকে খাবার কিনে ঘরে রাখবে এবং ব্রেকফাস্ট, ডিনার বাড়িতেই করবে| দেরি না কোরে চট কোরে হাত মুখ ধুয়ে ডিনার করতে এগোলাম|

ছোট্ট রেস্তোরা| বাইরে বোর্ডে কি কি খাবার পাওয়া যাবে লেখা রয়েছে| একটা টেবিলে বসলাম| খাবার পরিবেশনকারি ফ্রলাইন এসে গড় গড় কোরে জার্মান ভাষায় কি সব বলে গেল| মেয়েটি ইংরেজি বোঝেনা আর আমি জার্মান বুঝি না| মনে হল, কি খাব জানতে চাইছে| বোর্ডে লেখা দেখেছি কাটলেট, তাই বললাম কাটলেট| বলল, কটলেট? মাথা নাড়লাম, ইয়া| সঙ্গে কি খাবে, mit fritueren? Ya. Getraenke? বললাম lemonade. পরের প্রশ্ন, salat? Ya. আবার গড় গড় কোরে কি সব বলল| যাই বলুক, আমি সব কিছুতে ঘাড় নেড়ে Ya Ya করতে লাগলাম| দেখলাম একটু পরে কাটলেট, আলুভাজা, স্যালাড আর একটা ছোট লেমনেডের বোতল নিয়ে এল| খেলাম, ভালই হল খাওয়া| এবার দাম দিতে হবে| মনে হল, আলাদা আলাদা দাম বলে, শেষে যোগফল বলল| আমি তার এক বর্ণও বুঝলাম না| অগত্যা মানি ব্যাগ থেকে একটা বড় নোট বের কোরে সামনে ধরলাম| ফ্র্রলাইন নোট ভাঙ্গিয়ে অবশিষ্ট ফেরত দিলেন| হৃষ্ট চিত্তে ঘরে ফিরে এলাম পকেট ভর্তি খুচরো নিয়ে| চাবি দিয়ে main দরজা এবং ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢুকলাম| সটান শুয়ে ঘুমিয়ে পরলাম| আমার আখেনে প্রথম দিন শেষ হল|

আখেনে প্রথম তিন মাস

পরের দিন ভোরে ঘুম ভাঙ্গল সূর্যের আলো গায়ে এসে পড়ায়| ভাবলাম বুঝি অনেক বেলা হয়ে গেছে| হাতের ঘড়িতে দেখি 5:00. উত্তর গোলার্ধে, যত উত্তরে যাওয়া যায়, গ্রীষ্মকালে দিন তত বড় হতে থাকে আর রাত তত ছোট হয়| আগের দিন তাড়াতাড়ি শুতে গেছি, খেয়াল করিনি যে তখনো রাতের অন্ধকার নামেনি| এত ভোরে উঠে কি করবো? আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম, কিন্তু ঘুম এল না| একটু পরেই  উঠে পড়লাম| হাত মুখ ধুয়ে shower এ গরম জলে স্নান করে নিলাম| মনে পড়ল, সকাল আটটায় রুয়েস আসবে, তার আগে ব্রেকফাস্ট সারতে হবে, খাবার কিনে আনতে হবে| সাতটার আগে তো কোন দোকান খুলবে না| কিট ব্যাগের বইগুলো থেকে দরকারি বই বেছে টেবিলে রাখলাম, স্যুটকেস থেকে দরকারি জামাকাপড় আলমারিতে রাখলাম| নীচের দোকান থেকে পাউরুটি, মাখন, জ্যাম ইত্যাদি কিনে এনে খেয়ে নিলাম| গোছগাছ কোরতে কোরতে  দরজায় ঠক ঠক, রুয়েসের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম,- ঠিক আটটা বাজে| যেতে যেতে পথের দুপাশে নানরকমের জিনসপত্রের দোকান পড়ে| এসব দোকান থেকে কোন কিছু কিনতে রুয়েস আমাকে নিষেধ করলেন, এরা বড় বেশি দাম নেয়| আমি একটা সুন্দর দেখতে চা খাবার চিনেমাটির কাপ প্লেট কিনি, সাড়ে পাঁচ মার্কে| পরে দেখেছি, কাউফ-হোফ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে খুব সুন্দর কাপ-প্লেটের দাম দুমার্কের বেশি না|( সেসময়ে এক মার্কের বিনিময় মূল্য ছিল এক টাকা কুড়ি পয়সা মাত্র| পরে, বারে বারে টাকার ডিভ্যালুয়শন বা মূল্য হ্রাস হয়েছে|)

Institute পৌঁছে  দেখলাম এক মহিলা মেঝে পরিষ্কার করছেন| আমাদের দিকে তাকিয়ে Guten tag wish করলেন| রুয়েস ও প্রত্ত্যুত্তরে গুটেন টাগ জানালেন| আমি চুপচাপ ছিলাম| আরও দুএক দিন এমন হয়েছে| তারপর ভদ্র্রমহিলা আমার নামে অভিযোগ করলেন, যে আমি যথেষ্ট ভদ্রতা দেখাচ্ছি না| রুয়েস আমাকে বলল, Putz Frau( আমাদের দেশে ঝি) কে Guten tag না জানানো অমার্জনীয় অপরাধ| তুমি Prof Oswatitsch কে Guten tag না জানাতে পার, উনি কিছু মনে করবেন না, কিন্তু Putz-Frau কে অবশ্যই wish করবে| এটা একটা বড় শিক্ষা| আর, কারও সঙ্গে কথা বলতে হলে অবশ্য্ই প্রথমে Guten Tag, বা guten Morgen(শুভ সকাল) বা guten Abend(শুভ সন্ধ্যা) বলে শুরু করতে হবে! জার্মানিতে এই আমার দ্বিতীয় শিক্ষা|

Institute পৌঁছে পড়াশুনা শুরু করলাম| প্রথমেই অধ্যাপক সাহেবের পেপারের মর্মার্থ উদ্ধারে লেগে গেলাম| জার্মানরা বড় বড় বাক্য লিখতে ভালবাসে,- ইংরেজদের উল্টো| আমাকে বিশেষ একটি পদ্ধতি হাতেকলমে প্রয়োগ করতে হবে, তাই যথার্থ অর্থ উদ্ধার প্রয়োজন| কিছুটা অগ্রসর হবার পর একটা বাক্যে এসে আটকে গেলাম| একাধিক বার পড়লাম এবং অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে চলেছি| আটকাচ্ছে একটি শব্দে| শব্দটি হল “also”, যার আভিধানিক অর্থ হল ইংরেজি thus. আমার মাথায় ঘুরতেই থাকল| বেশ কিছুদিন পরে বুঝেছি শব্দটার প্রয়োজন নেই, ওটা নেহাৎই অধ্যাপক সাহেবের মুদ্রাদোষ| লাঞ্চের সময় হতে সবাই খেতে গেলাম| খাবার পরে, রোটমানের সঙ্গে গরম জামাকাপড় কিনতে Adalbert Strasse তে গেলাম| ওখানে একাধিক বড় বড় দোকান আছে| রোটমানের পরামর্শে একটা Zaako বা মোটা গরম কাপড়ের কোট, যা সব সময় পরা চলে,  একটা গরম প্যান্ট ও একটা পুরো হাতার সোয়েটার কিনলাম| এরপর চা কফি বানানোর ব্যবস্হা করলাম| একটা Tauch-Sieder(immersion heater), একটা হট-প্লেট কিনলাম যাতে ব্রেকফাস্ট, ডিনার বাড়িতেই করতে পারি| একটু থিতু হবার পর ব্রেকফাস্ট খুব সরল কোরে ফেললাম| সকালে Institute যাবার পথে কোন একটা বেকারি থেকে ছোট একটা মিষ্টি পাউরুটি কিনে পকেটে কোরে নিয়ে যাই, আর একবোতল হাফ-লিটার ঠান্ডা কাঁচা দুধের সঙ্গে খাই| Institute এর যে সব মেয়ে Computational assistant  রয়েছে, তারাই দোকান থেকে দুধ কিনে এনে টেবিলে রেখে যায়, বিজ্ঞানিদের মধ্যে যারা দুধ খেতে চান তাদের জন্য| নানারকম মিস্টি রুটি পাওয়া যেত বেকারিগুলিতে, যেমন, rosinen broetchen, streusel ব্র্যোটশেন ইত্যাদি, অর্থাৎ কিসমিস দেওয়া ছোট রুটি, চিনি ছড়ানো ছোট রুটি ইত্যাদি| আরও নানারকমের মুখরোচক ছোট রুটি পাওয়া যেত| ঘুম থেকে উঠে, হাত-মুখ ধুয়ে প্রথমেই এক কাপ চা বানাতাম| চা খেয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে জামাকাপড় পরে ইনস্টিটিউটের দিকে রওনা দিতাম| প্রায়ই রুয়েস আমার সঙ্গে যেত|

  একটা ছোট রুটি আর আধলিটার কাঁচা দুধে আমার ব্রেকফাস্ট সারতাম, দুপুর একটা পর্যন্ত ক্ষিধে পেত না| বিকেল চারটেতে এক কাপ কফি, তারপর সন্ধ্যা ছয়টায় বাড়ি ফিরে ডিনার,- এই হল আমার রোজকার খাবার নির্ঘন্ট| ডিনার করতাম জ্যাম ও মাখন লাগানো চারপিস বড় পাউরুটি, আধলিটার দুধ, সঙ্গে ডিম সিদ্ধ, সসেজ ও চা| রাত্রে শোবার আগে একটা আপেল বা অন্য কোন ফল খেতাম| ছুটির দিনে বা শনি রবিবার অন্যরকম,-পরে আসছি| পাউরুটি, মাখন, ডিম, সসেজ, আপেল, কলা ইত্যাদি খাবার কিনে বাড়িতে রাখতাম| চা, কফির সঙ্গে খাবার জন্য নানারকমের সুস্বাদু বিস্কুট কিনে রাখতাম| এইভাবে খাওয়া চালিয়ে চার মাস পরে ওজন নিয়ে দেখি দশ কেজি বেড়ে 65 কেজি হয়েছে|

গেছি গবেষণা করতে, কোথায় গবেষণা বিষয়ে আলোচনা করব, তা না সারাক্ষণ খাওয়ার চিন্তা! খুটিনাটি বিষয়ে চিন্তা| পেট খালি রেখে গবেষণা হয় না| তাই খাওয়ার ব্যবস্হা করতে হয় সর্বাগ্রে|

 মনে পড়ে যায় এগারো বছর আগের ২৩শে মার্চের কথা, যে রাতে সপরিবার এক বস্ত্রে আমরা আটটি প্রাণী প্রাণ হাতে কোরে শিয়ালদহ স্টেশনে আশ্রয় নিই| সেদিন আমাদের পরিচয় ছিল উদ্বাস্তু, ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্য যাদের সাপ্তাহিক ডোল বা সরকারি সাহায্য মিলত 40 টাকা| তখনও দী্র্ঘদিন ধরে দিনের পর দিন আমাদের একটাই চিন্তা ছিল আহার্য্যের ব্যবস্হা করা| “চূনের খুঁটি থেকে নুনের বাটি” পর্যন্ত যৎযাবতীয়, একটা সংসার চালাতে হলে, না হলে নয় এমন সব কিছু কিনতে হয়েছে| আমাকেও এখন সব কিছু নতুন করে কিনতে হচ্ছে| পার্থক্য একটাই, তখন অর্থাৎ এগারো বছর আগে আমাদের নিদারুন অর্থাভাব ছিল, আর এখন আমাকে টাকার জন্য ভাবতে হবে না| আমার জন্য অধ্যাপক সাহেব প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট অর্থের ব্যবস্হা করে রেখেছেন|

বুধবার দিন অনেকে লাঞ্চ পর্যন্ত কাজ করতেন| এরা শনিবার সকালে অর্ধেক দিন কাজ করতেন| আমি অবশ্য বুধবার অর্ধেক দিন ছুটি নিতাম না, শনি ও রবি পরপর দুদিন ছুটি উপভোগ করতাম| ছুটির দিনে দশটা এগারোটার আগে শয্যাত্যাগ করতাম না| ব্রেকফাস্ট করে আস্ত একটা গ্রিলড-চিকেন ও আলুভাজা(finger chips) কিনে আনতাম, মোটামুটি দুমার্কে|  তাই খেয়ে সারাদিন আর ক্ষিধে পেত না| রাত্রে হয়ত, ক্ষিধে পেলে একটা আপেল বা অন্য হাল্কা কিছু খেয়ে নিতাম| বোতলে আপেলের রস আমি প‍‍ছন্দ করতাম| ভাত রান্না করতে চেষ্টা করতাম, জলের মাপটা ঠিক করতে অনেকদিন লেগেছে| ভাতে একটু ফ্যান যেন থেকেই যেত| মুরগির ঝোল রান্না করার ও চেষ্টা করতাম, উদ্দেশ্য মুরগির ঝোল আর ভাত খাওয়া| তবে যা  রান্না হোত, তা খাওয়া সোজা নয়!

কয়েকদিনের মধ্যেই আমার রোজকার কাজকর্ম একটু স্থিতি লাভ করল| ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে এক কাপ চা খেয়ে আটটা সওয়া আটটার মধ্যে হেঁটে ইনস্টিটিউটের উদ্দেশে রওনা দিতাম| অনেকদিন রুয়েস ও একই সময়ে বের হত| বেশ গল্প করতে করতে যাওয়া যেত নানা বিষয়ে| গবেষণা সংক্রান্ত কোন কিছু জিজ্ঞাস্য থাকলে রুয়েস তা  হৃষ্টচিত্তে নিরসন করতে লেগে যেত| ওর কাছথেকে সদাসর্বদা অকুন্ঠ সাহায্য ও উপদেশ পেয়েছি| অন্য সহকর্মিদের ব্যবহার ও ছিল অত্যন্ত ভাল| সন্ধ্যায় ডিনারের পর হয়ত  রাস্তা দিয়ে একটু হেঁটে এলাম, বা আবার একটু বই নিয়ে বসলাম| হয়ত বা বাংলা গল্পের বই| দেশের খবর জানার খুব ইচ্ছে করত| একটা পুরোনো all wave রেডিও কিনলাম এক  ছাত্রের কাছ থেকে, ১০০ মার্কে| তাতে All India Radio র ইংরেজি সংবাদ ধরতাম, তবে noise বেশি আসত, বাংলা অনুষ্ঠান অবশ্য ধরা যেত না| বাড়িতে বাবাকে, মাকে চিঠি লিখতাম inland letter এ| বাবা সঙ্গে সঙ্গে চিঠির উত্তর দিতেন পোষ্টকার্ডে| পোষ্টকার্ড অনেক তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছয়| অনেকদিন আবার উত্তর লিখে বাবা GPO তে গিয়ে চিঠি পোষ্ট করতেন| একেবারে সাহেবদের মত যথাসত্বর চিঠির উত্তর দেবার অভ্যেস ছিল বাবার| কোনরকম দীর্ঘসূত্রীতা ছিল না| রাতে আমি দশটা সাড়ে দশটায় শুয়ে পড়তাম|

জার্মান ভাষাটা ভাল করে শেখা দরকার| বন্ধুদের পরামর্শে জার্মান খবরের কাগজ পড়া শুরু করলাম| হাতের পাশে Cassel এর মোটা অভিধান নিয়ে বসতাম| সমস্যাটা হল কথ্য ভাষায়, দোকানে কেনাকাটার সময়ে বিশেষ কোরে| ইনস্টিটিউটে আমার সহকর্মীরা আমার সঙ্গে ইংরেজি বলতেন| কাজেই কথ্য ভাষা শিখতে আমার বেশ কয়েক মাস সময় লেগেছে| তিন মাস পরে, T.H. তে জার্মান ভাষা শেখার ক্লাসে ভর্তি হই| সন্ধ্যার দিকে প্রথম প্রথম খুব একা লাগত| জার্মানরা বলে heimweh বা বাড়ির জন্য কষ্ট| হয়ত বা “কচ ও দেবযানী” সংবাদ পড়তাম| এই সময় একাকীত্বের কষ্ট লাঘব হয়েছে রবীন্দ্রনাথ পোড়ে| প্রথম তিন মাস একটা বাংলা শব্দ বলিনি বা শুনতে পাইনি, জার্মান ও ভাঙ্গা ভাঙ্গা দুচারটে শব্দ বোলতে পারি, আরো অল্প বুঝতে পারি, তাই ইংরেজিতেই কথাবার্তা বোলতে হয়েছে| আমি বাংলা মাধ্যম স্কুলের ছাত্র, ইংরেজিও ভাল জানিনা| মোটামুটি কাজ চালানোর মত জার্মান শিখতে সময় লেগেছে চার পাঁচ মাস| চেষ্টা চালিয়ে গেছি| বছরখানেক পরে মনে হোল আমি ইংরেজির চেয়ে জার্মান ভাল বলি এবং সহজে বুঝি|

অধ্যাপক অসভাটিচের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকার

আখেনে পৌঁছবার মাস খানেক পরে,  অধ্যাপক অসভাটিচ   ভিয়েনা থেকে আখেনে এলেন ট্রেনে| প্রায় আঠেরো ঘন্টার জার্নি| রাত্রে ট্রেনেই ঘুমিয়েছেন| সকালে  শোয়র্ৎছেনবার্গারের সঙ্গে কিছু কাজ সেরে উনি আমার ঘরে এলেন| শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর জানতে চাইলেন, আমার জার্নি কেমন ছিল, এখানে কোন অসুবিধে হচ্ছে কিনা| জার্মান ভাষা একটু শিখেছি কিনা, খাওয়া দাওয়ার অসুবিধে হচ্ছে কিনা| তারপর বললেন, একটু পরে তোমার সঙ্গে তোমার গবেষণা বিষয়ে কথা বলব, বলে উনি অন্য কাজে গেলেন|

ঘন্টাখানেক পরে রুয়েস আমার ঘরে এসে বলল, তোমার কাগজপত্র নিয়ে  সেমিনার রুমে চল, অধ্যাপক সাহেব আলোচনা করবেন| বেশ সিরিয়াস আলোচনা| আমার Problemর টি আমি black board এ ছবি এঁকে ও অঙ্ক কষে উপস্থাপিত করলাম, এবং এর সমাধানে এপর্যন্ত যা করেছি ও চেষ্টা করছি তা বললাম| উনি মন দিয়ে শুনলেন ও কি ভাবে এগোব, সে সম্বন্ধে উপদেশ দিলেন| এই ভাবে আমার গবেষণার কাজ এগিয়ে চলল|

অধ্যাপক সাহেব মাঝারি গড়নের, ভালই ইংরেজি বলেন, তবে সব কিছু করেন বা বলেন অত্যন্ত দ্রুত| পরে দেখেছি চিন্তাও করেন অত্যন্ত দ্রুত| শরীরের তুলনায় মাথাটা বেশ বড়| আমি ভেবে রেখেছিলাম, এতদিন ধরে এত গবেষণা করছেন বুঝি বেশ বুড়ো হবেন| কিন্তু একেবারেই বুড়ো নন, বয়স 50/55 র বেশি হবে বলে মনে হল না| ইনস্টিটিউটের সবাই তটস্থ হয়ে আছে, অথচ মনে হয় নিপাট ভাল মানুষ| সহকর্মীদের কাছে শুনেছি, উনি ভিয়েনা টেকনিকাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, Schroedinger এর কাছে Quantum Mechanics এ Ph.D. করেন| তারপর গবেষণার ক্ষেত্র সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে Goettingen এ চলে আসেন  আধুনিক Fluid Dynamics এর জনক Prandtl এর কাছে 1938সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে| তখন ramjet আবিষ্কারের ফলে বিমানের বেগ  অনেকটা বৃদ্ধি সম্ভব হয়| High speed Gasdynamics বিষয়টার সৃষ্টি চলেছে এবং বিভিন্ন প্রয়োগে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে| Prandtl ওঁকে এই বিষয়েই কাজ কোরে যেতে বলেন| 1944 নাগাদ মিত্রশক্তি Goettingen দখল কোরে নেয়| সেখানকার বিজ্ঞানীদের কিছু যায় America, কিছু Russia তে এবং কিছু England এ| অসভাটিচ যান লণ্ডনে| সেখানে কিছুদিন থাকার পর সুইডেনে Technical University তে Professor পদে যোগ দেন| যুদ্ধে পরাজিত জার্মানরা দশ বছর Aerodynamics, Gasdynamics ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা বা কোনরকম চর্চা করতে পারবে না, কোনরকম বিমান তৈরী করা চলবে না, ইত্যাদি সর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়| মেয়াদ শেষ হবার পর, 1956 সালে, প্রাইভেট উদ্যোগে DVL(Deutsche Versuchsanstalt fuer Luftfahrt) সংস্থা তৈরি হয়| তারাই আখেন সহরে Institut fuer Theoretische Gasdynamik প্রতিষ্ঠা করেন ও অধ্যাপক অসভাটিচকে তার ডিরেক্টর তথা সর্বময় কর্তা নিযুক্ত করেন| এর পাঁচ বছর পরে, আখেনে এই ইনস্টিটিউটে আমি গবেষণার কাজে যোগ দিই| যাদবপুর বিশ্বিদ্যালয়ে আমি Lecturer ছিলাম বিবেচনা করে উনি আমাকে Wissenschaftliche Mitarbeiter করে নেন| তবে একটা সমস্যা ছিল, আমার Ph.D. বা M.Tech. ডিগ্রি ছিল না| তাই আমাকে পুরো বেতন না দিয়ে  মাসে 600 Dmark করে দেবার ব্যবস্হা করলেন| একজন ডক্টরেট করতে যাওয়া ছাত্রের পক্ষে, তখনকার দিনে এটা অনেক টাকা| পরে দেখেছি অন্যান্য ভারতীয় ছাত্ররা 300 বা সাড়ে তিনশো মার্কেই সারা মাসের খরচ চালাতেন|

বাঙ্গালিদের সঙ্গে যোগাযোগ

এই সময়, অক্টোবর মাসের শেষের দিকে, একদিন আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায়, আমার পাস দিয়ে দুটো ছেলে বাংলায় কথা বলতে বলতে যাচ্ছে, শুনতে পেলাম| ডেকে, ওদের সঙ্গে কথা বোলে জানলাম, ওরা থাকে Studenten dorf বা ছাত্রদের গ্রামে| আমার বাসা থেকে কিলোমিটার দুয়েক দূরে| আখেনে অনেক বাঙ্গালী ছেলে আছে, পড়াশুনা করছে| ওরা এখন গ্রীষ্মের ছুটিতে অন্যত্র Summer job করছে| ২রা নবেম্বর নতুন সেমেস্টার শুরু হবে| তার আগেই ওরা সব ফিরে আসবে| তখন চারপাশে অনেক বাঙ্গালী দেখতে পাবেন|

হলও তাই| কয়দিন পরে, একটি বাঙ্গালী ছেলে এসে একদিন আমার সঙ্গে আলাপ করল| নাম অনাথবন্ধু রেজ| মাইনিং পড়ে প্রথম সেমেস্টার| আমাদের বাড়িতেই পাঁচতলায় থাকে| আমি ততদিনে দোতলার ঘরে উঠে এসেছি|

ওর কাছেই শুনলাম দোতলায় আর এক বাঙ্গালী থাকে| একজন ইরাণী ছেলের সঙ্গে share কোরে| নাম সজলকান্তি লোধ, মেটালার্জি পড়ে, একটু সিনিয়র| দুএক দিনের মধ্যে আর একজনের সঙ্গে আলাপ হল, সুনীল মুখার্জী নাম| কলকাতা থাকতে এক পরিচিতের মাধ্যমে এর ঠিকানা পেয়ে একে আমি একটা চিঠি লিখেছিলাম| বাইরে থাকায়  উত্তর দিতে পারে নি| সুনীল থাকে সাত আট কিলোমিটার দূরে Eilendorf নামে একটা গ্রমে, যদিও আমাদের বাড়িতে ওকে প্রায়ই দেখা যেত| বেশ একটা আড্ডার পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল|

আখেনে প্রথম শীতকাল

অক্টোবর থেকেই রাতের দিকে একটু একটু ঠান্ডা পড়া সুরু হল| সেন্ট্রাল হিটিং এর কল্যাণে ঘরের মধ্যে অবশ্য বোঝার উপায় নেই| আখেন সহর সমুদ্র থেকে বেশি দূরে নয়| তাই এখানে তেমন জোর ঠান্ডা পড়েনা| প্রবল শীতের সময় ও min.temp. -15এর নীচে বড় একটা নামে না| তখন দিনের max.temp. কখনো কখনো শূন্য ডিগ্রির নীচেই থাকে| আমার জার্মান বন্ধুদের কাছ থেকে পরিধেয় ইত্যাদি বিষয়ে প্রয়োজনীয় উপদেশ পাই| নবেম্বর মাসটা গরম কোটের উপর একটা পাতলা সামার কোট পড়লেই চলে, যদিও ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বাইরে বের হতে হলে মোটা ওভারকোট চাই| শীতকালে সব্জির আমদানি কমে যায়| তখন মাংস ও আলুর সঙ্গে Sauer kraut, অর্থাৎ টক বাঁধাকফি(বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি) এদের প্রধান খাদ্য হয়ে দাঁড়ায়|

নবেম্বর মাসের গোড়ায় আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লাম সর্দি-জ্বর, সঙ্গে প্রবল গা হাত পা ব্যথা| এতটাই কাবু হয়ে পড়লাম যে ইনস্টিটিউট যেতে পারিনি, শুয়েই রইলাম| তারিখটা মনে আছে 7th, november 1961. আখেনে যে চার বছর ছিলাম কদাচিৎ অসুস্থ হয়েছি| তাই তারিখটা মনে রয়ে গেছে| ইনস্টিটিউটে যাই নি দেখে পরের দিন সকালে রোটমান আমার খোঁজ নিতে এল| appointment না কোরে জার্মানরা কেউ কারু বাড়ি যায় না| ফ্রলাইন স্টেগ ওকে আমার খোঁজ নিতে বলেছে| রোটমান বলল আমি তোমার জন্য ওষুধ নিয়ে আসছি| একটু পরেই ওষুধ নিয়ে এল, Novalgin-khinin, অর্থাৎ ক্যুইনাইন যুক্ত নোভালজিন| দুতিনটে ট্যাবলেট খেয়েই উঠে দাঁড়ালাম, জ্বর ছেড়ে গেল এবং ইনস্টিটিউট যেতে পারলাম| অবশ্য, কাশি সারতে একটু সময় নিয়েছে| শুনেছি, এই ওষুধটা পরে নিষিদ্ধ হয়ে যায়|

রাত্রের দিকে রেজ যোগাযোগ করে| কি খাচ্ছি জানতে চায়| শনি-রবিবার সকালের দিকে এসে রান্নার বিষয়ে নানা পরামর্শ দেয়| ঝরঝরে ভাত, ফ্যান না গেলে কিভাবে রাঁধতে হয় ওর কাছে শিখলাম| আর শিখলাম মুর্গির ঝোল রান্না| প্রয়োজনীয় সব রকম মশলা এখানে পাওয়া যায়| মশলাগুলোর জার্মান নাম ও শিখে নিলাম| কাউফ-হোফ নামক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে এগুলো সব পাওয়া যায় এবং অন্য দোকান থেকে দাম ও সস্তা| খুব শিঘ্রি আলাদা রান্না না কোরে, শনি-রবিবার একসঙ্গে রান্না খাওয়া শুরু করলাম| এতে আমাদের একঘেঁয়েমি কিছুটা কমল আর অর্থের সাশ্রয় তো হলই| কিছুদিনের মধ্যেই আরেকজন আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন| তিনি হলেন নরেশ বিকাশ দাশগুপ্ত| আমাদের বাড়ির দুটো বাড়ি পরে একটা বাড়ির দোতলায় থাকেন| Ceramics এ Ph.D. সুরু করেছেন| কলকাতায় Glass and ceramics নিয়ে পড়েছেন| কলকাতার ডিগ্রি recognition নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে, undergraduate এর অনেকগুলো বিষয় ওকে পরীক্ষা দিয়ে আগে পাস কোরে নিতে বলেছে| দাশগুপ্তর দেশ চট্টগ্রামে| মানুষ খুব ভাল, সহজ সরল, রেজও খুবই ভাল মানুষ| অল্পদিনের মধ্যেই আমরা বেশ বন্ধু হয়ে গেলাম| বিশেষ কোরে, শনি-রবিবার প্রায় সারাদিনই একসঙ্গে কাটাতাম| দুপুরে খাবার পর বাসনপত্র্র ধুয়ে মুছে একসঙ্গে হাঁটতে বেরোতাম| দাশগুপ্তর অবশ্য ইচ্ছে থাকত, পেট ভরে খাবার পর একটু ঘুমিয়ে নেবার, কিন্তু আমরা ঘুমতে দিতাম না|

ধীরে ধীরে আরও কয়েকজন বাঙ্গালী ছাত্র আমাদের বাড়ি মাঝে মাঝে আসতে লাগল| বিশেষ কোরে বলতে হয় সুব্রত গাঙ্গুলী, পোদ্দার, সাহা চৌধুরি, ভৌমিক, দে র নাম-যারা প্রায়ই এসে আড্ডা দিতেন  এবং রেজের রান্নার স্বাদ নিয়ে যেতেন| এদের সকলের কাছেই আমি ছিলাম নিয়োগীদা| এদের মধ্যে অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই| যারা বেঁচে আছেন, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই, কে কোথায় আছে তাও জানিনা, গাঙ্গুলী আর দে ছাড়া| সব মিলিয়ে week-end গুলো আমাদের ভালই কাটত| এরা সবাই undergraduate ছাত্র, কমবেশি পাঁচ ছয় বছর পর Diplom Engineer(M.Tech) হবে, পরীক্ষা পাস করলে| প্রায় সকলেই দেশ থেকে B.Sc.(Pass) পাস কোরে জার্মানি এসেছে, হয়ত কোন factory তে apprentice এর কাজ নিয়ে| দুএক বছর কাজ কোরে টাকা জমিয়ে T.H. Aachen এ ভর্তি হয়েছে| Summer vacation এ কাজ কোরে অনেকে নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালায়| আর দীর্ঘকাল জার্মানিতে থাকতে হবে দেখে, হয়ত জার্মান বান্ধবি ও জুটিয়ে নেয়| ভাল নাচতে জানলে বান্ধবি জোটানো সহজ হয়| তাই অনেকে নাচের স্কুলে ভর্তি ও হয়| আমার চেনাজানা বাঙ্গালি ছাত্রদের প্রায় সকলেরই জার্মান বান্ধবি ছিল| আরও বহু ভারতীয় ছাত্র তখন আখেনে ছিল, কমপক্ষে আড়াইশো| ভারতীয় ছাত্রদের একটি Association ছিল, নাম Verein Indischer Studenten বা “ভারত মজলিস”| এরা নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করত| দাশগুপ্তর বাড়ির উল্টোদিকে প্রাচীরঘেরা একটা বাড়ি ছিল, Alexander von Humboldt ভবন| এই বাড়িতে  একটা বড় furnished hall ছিল, রান্না ঘরে পর্যাপ্ত বাসনপত্র ইত্যাদি ও রান্নার সরঞ্জাম ছিল| বিদেশি ছাত্রদের association কে Humboldt Foundation এই বাড়ি ব্যবহার করতে দিত|

 বাঙ্গালি ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় ঘনিষ্টতা হবার পর থেকে heimweh আর বড় একটা বুঝিনি| ধীরে ধীরে জার্মান কথ্য ভাষাও অনেকটা রপ্ত হয়ে গেল| দিনগুলো ভালই কাটতে লাগল| গবেষণাও এগিয়ে চলল| প্রথম যে Problem এ কাজ করছিলাম, সে সম্বন্ধে আগেই বলেছি| এই কাজ শেষ করতে প্রায় বছর খানেক লাগে| আমার লেখা Inviscid Gasdynamics বইতে, Transonic Flow অধ্যায়ে এটি সংক্ষেপে বলা আছে| সেই সময় খুব কম বিজ্ঞানি বা ইন্জিনিয়র transonic flow নিয়ে কাজ করতেন, কারন বিষয়টা অত্যন্ত দুরূহ, theoretically ও experimentally. যারা শুরু করেন, কিছুদিন পরে তারা ছেড়ে দেন ও অন্য বিষয় ধরেন| আমি অবশ্য নিরুৎসাহ হই নি| অধ্যাপক অসভাটিচের ও উৎসাহের অভাব ছিল না|

ছুটির দিনে বাঙ্গালি বন্ধুরা প্রায়ই আসত, আর রেজ ও দাশগুপ্তরা তো ছিলই| রোটমান ওর Research project শেষ করে দেশে ফিরে যায়| অস্ট্রিয়ার গ্রাৎস সহরে ওর বাড়ি| পরে Ph.D. করার জন্য ও আবার এই ইনস্টিটিউটে ফিরে আসে| এর মধ্যে আর একজন Physics এর ছাত্র M.Tech. Project(Diplom Arbeit) করতে আমাদের ইনস্টিটিউটে যোগ দেয়|  বসে আমার ঘরেই| নাম Peter Boettger. তখন মনে হয় ওর ১৩/১৪ সেমেস্টার চলছে| ব্যোটকারের বাড়ি হ্যানোফার(Hannover) সহরে| Abituer(13 ক্লাসের শেষের স্কুল-ফাইনাল পরীক্ষা) পাস করার পর ওর বাবা ওকে বলেন, তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছ(19 বছর), এবার নিজের পথ নিজে দেখ, তোমার পেছনে আমি আর টাকা খরচ করতে পারব না| ওর ইচ্ছে ছিল আরও পড়াশুনা চালিয়ে যাবার|  তার পরিবর্তে অর্থ উপার্জনের জন্য বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হল| ছোটখাটো নানারকমের কাজ, উটকো কাজ, যা জোটে তাই করতে হয়েছে পাঁচছয় বছর, সঙ্গে পড়াশুনা চালিয়ে গেছে| কায়িক পরিশ্রমই বেশি| বাড়ি তৈরির কাজে যোগাড়ের কাজ করতে হয়েছে অনেকদিন| ওর সহকর্মিরা কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর বিয়ার পান করত| সে অভ্যাস ওকেও ধরে| বহুদিন গেছে, খাবারের বদলে বিয়ার খেয়েছে| বেঁটে খাটো গাট্টাগোট্টা চেহারা, মাথা থেকে চুল অনেকটাই উঠে গেছে| অনর্গল ইংরেজি বলতে পারে আমেরিকান উচ্চারনে, অনেকদিন আমেরিকান একটা দলের সঙ্গে কাজ করেছিল| কিন্তু ইংরেজি বলায় ঘোর অনীহা| আমাকে বলল, তোমার সঙ্গে আমি ইংরেজি বলব না, শুধু জার্মান ই বলব, তুমি ও আমার সঙ্গে জার্মান বলবে, ভাঙ্গাচোরা হোক, ভুলভাল হোক তাতে কিছু আসে যায় না, যা পার তাই বলবে|

ব্যোটকার আসার পর থেকে আমার জার্মান বলার অভ্যাস ভীষণভাবে বেড়ে গেল| সন্ধ্যাবেলা ডিনারের পর ও আমার বাড়ি আসত আর বলত, চল আমরা একটা বিয়ার খেয়ে আসি| আমি বিয়ার খেতাম না, আমি আপেলের রস নিয়ে বসতাম, ও অনর্গল বক বক করে যেত| কিন্তু বেশি দিন আমার আপেলের রস খাওয়া চালিয়ে যেতে পারলাম না| একআধ গেলাস আমিও খাওয়া ধরলাম| বেজায় তেতো, চিরতা থেকে তৈরি| অল্প পরিমান alcohol থাকে, হয়ত শতকরা তিন-চার ভাগের বেশি না| জার্মানরা জল খায় না, পরিবর্তে বিয়ার খায়| বিয়ারের দাম ও তুলনায় সস্তা| বেশ কিছু উপকারিতা আছে বিয়ার খাবার| ওরা বলে, বিয়ার হল, “Fluessiges Brot”, অর্থাৎ fluid bread. বিয়ার খেলে শরীরের ময়লা পেচ্ছাপের সঙ্গে বেরিয়ে যায়| আর তেতো জিনিস খেলে লিভার ভাল থাকে, অবশ্য পরিমিত মাত্রায় খেলে| বেশি খেলে নেশা হবে, সেটা ভাল নয়| ব্যোটকারের সঙ্গে বেরিয়ে আমরা কাছাকাছি কোন ক্নাইপে বা বিয়ার-পাবে গিয়ে বসতাম| এক গ্লাস বিয়ার খেলে রাত্রে ঘুমটা ভালই হত, যদিও বয়স কম ছিল বোলে তখন এমনিতেই ভাল ঘুম হোত| ব্যোটকার অনর্গল বক বক কোরে যেত| ওর সঙ্গে কথা বোলতে বোলতে খুব শিঘ্রি জার্মান শিখে গেলাম|

আখেনে আমার প্রথম ক্রিসমাস

আখেনের ক্রিসমাস কলকাতার বা পার্কস্ট্রিটের ক্রিসমাস উদযাপন থেকে  আলাদা ধরনের| কলকাতায় বড়দিন হল আনন্দ-উৎসব, নাচ-গান হৈহুল্লোড়, খাওয়া-দাওয়া, আলোর উৎসব| আখেনে কিন্তু অত্যন্ত গুরুগম্ভীর রূপে ক্রিসমাস পালিত হয়| জার্মানরা কাজপাগলা জাত, কাজে ফাঁকি দিতে শেখেনি| ওরা বলে এবং বিশ্বাস করে, “Arbeit macht das Leben Zuess”, অর্থাৎ কাজ জীবনকে মিষ্টি করে তোলে| ইংরেজরাও বলে, “Work is worship”, কিন্তু বিশ্বাস করে ক’জন! জার্মানরা একটা অদ্ভূত জাতি, যেন মিথ্যে কথা বলতে শেখেনি| ওদের মুখের কথা বিশ্বাস করা যায়, বহুবার দেখেছি| একটা উদাহরণ দিই|

আমাদের ইনস্টিটিউটে Computational assistant পদে যে সব মেয়েরা কাজ করত, তারা সবাই দশ ক্লাস পাস| ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণালব্ধ ফল গ্রাফের মাধ্যমে প্রদর্শন করতেন| এর জন্য গ্রাফ বা প্রয়োজনীয় numerical calculation করতেন এই সব computational assistant বা গনণ সহকারি মেয়েরা| যে চার বছর আমি ইনস্টিটিউটে ছিলাম, এই সহকারি মেয়েদের গনণকার্যে ভুল হতে দেখিনি বা শুনিনি| অনুরূপ কাজের জন্য এখানে আমরা হয়ত এম্.এস্.সি বা Ph.D. খুঁজব| অনেকক্ষেত্রেই তাদের কাছ থেকে নির্ভুল গনণ হয়ত আশা করব না|

 গ্রীষ্মকালে ইনস্টিটিউটের সহকর্মীরা তিন-চার সপ্তাহের ছুটিতে বেড়াতে যায়| এটা paid holiday. ওরা বলে Urlaub, এবং সবাই ছুটিতে যাবে, এটাই কাম্য| আমিও চিন্তা করা সুরু করলাম কোথায় যাই| একা যেতে হবে, অজানা জায়গায়| কেমন একটা অস্বস্তি লাগছিল| বাঙ্গালি বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে, প্রথমবার আমি যাই বিলেতে বা লণ্ডনে| দেশ দেখা হবে, এই উদ্দেশ্য| Urlaub এর মূল উদ্দেশ্য হল শরীর ও মনের পূর্ণ বিশ্রাম| বড় সহরে ঘুরে বেড়ালে তা হয় না|



Leave a comment