Dr. Pradip Niyogi's Blog

My write ups on a mixed bag of topics – from my perspective


Importance of Mother tongue in Education System

মাতৃভাষা দিবস  ও আমাদের শিক্ষার মাধ্যম

২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিন  উভয় বাঙলায় আমরা বীর ভাষাশহিদদের স্মরণ করি ও আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করি|

ভাষার জন্য আত্মবলিদান পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বিরল ঘটনা। অনেক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, অনেক চোখের জলের মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে।  বাংলা ভাষাভাসিদের দায়দায়িত্ব কিন্তু অনেকগুণ বেড়ে গেছে| বাংলা ভাষাকে উন্নত করা ও তার শ্রীবৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার বা চালিত করার গুরূদায়িত্ব কিন্তু প্রত্যেক বাঙ্গালীর| এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন মাতৃভাষার প্রতি অকুন্ঠ ভালবাসা| প্রতিবছরই পৃথিবীতে বহু ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে বা বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে| তাই স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বাংলা ভাষার এমন দুর্দৈব হবে না তো? আমরা বাঙ্গালীরা কি মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায়দায়িত্ব সঠিক পালন করছি? একটু নিষ্পৃহভাবে দেখলে, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে দেখি যে আজও বাংলাভাষা পূর্ণাঙ্গ, বা  সাবালক, হয়ে ওঠেনি| যে ভাষায় মানুষ তার মনের সূক্ষতম ভাব-অনুভূতি সম্পূর্ণরূপে ও সঠিক রূপে প্রকাশ করতে পারে সে ভাষাই পূর্ণাঙ্গ বা সাবালক| কাব্য, সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষার

তালিকায় বাংলা ভাষার স্হান হলেও অন্য অনেক বিষয়ে বাংলা ভাষা এখনো তার শৈশব অতিক্রম করেনি বা নিতান্তই নাবালক দশায় রয়ে গেছে| কাজেই, বাংলা ভাষাকে পূর্ণাঙ্গ বলা চলে না| একটু বিশদে বলি|

 একটু নজর করলে আমরা দেখি যে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন উচ্চতর শাখা বাংলা ভাষার মাধ্যমে চর্চা করা হয় না বা চর্চা করা যায় না|  তেমনি, কারিগরিবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, আইনশাস্ত্র ইত্যাদি একাধিক বিষয়ে  পঠন-পাঠন ও চর্চা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই করা হয়| বাংলা ভাষায় এই স্তরের পাঠ্যপুস্তক পশ্চিমবঙ্গে বা বাংলাদেশে রচিত হয় নি| তেমনি, ইন্জিনিয়ারিং কলেজে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশুনা ও গবেষণা চলে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে, বাংলা ভাষার সেখানে কোন স্হান নেই| চিকিৎসা  বিজ্ঞান বা আইনশাস্ত্র, এমন কি বাণিজ্য বা হিসাবশাস্ত্র, ম্যানেজমেন্ট, পঠনপাঠন,  চর্চা ও গবেষণায় পরিস্হিতি অনুরূপ| এই সমস্ত বিষয় যতদিন বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান, চর্চা ও গবেষণা করা সম্ভবপর হবে না ততদিন কিন্তু বাংলাভাষা পূর্ণাঙ্গ বা সাবালক পর্যায়ে উত্তীর্ণ হবে না| বীর ভাষাশহিদদের  আত্মাকে যথোপযুক্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হলে, এরূপ উত্তরণে প্রত্যেক  বাঙ্গালীকে সাধ্যমত সচেষ্ট হতে হবে যাতে একাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়| এই দায়িত্ব প্রত্যেক বাঙ্গালীর| কাজটি বিরাট এবং কঠিন সন্দেহ নেই, কিন্তু সদিচ্ছা থাকলে,  সবাই মিলে কাজ করলে, অসম্ভব নয়|

শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের  ভাষার  অগ্রাধিকার-

শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অর্থাৎ ভারতীয়দের ভাষার অগ্রাধিকার, আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে লর্ড মেকলে ঠিক করে গেছেন| গঙ্গা দিয়ে ইতিমধ্যে অনেক জল বয়ে গেছে কিন্তু শিক্ষায় আমাদের ভাষার অগ্রাধিকার আজও একই আছে, আমরা লর্ড মেকলেকে অনুসরণ করে চলেছি| তাঁর লক্ষ্য ছিলঃ “…to build a class of persons who are Indian in blood and colour, but English in taste, in opinion, words and intellect.” তাঁর বিশ্বাস ছিল, “ Indians cannot be educated through their mother tongue.”

(দ্রষ্টব্য: সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় রচিত পুস্তক: “কি শিখি কেন শিখি”, মহাবোধি বুক এজেন্সি, কলকাতা-৭০০০৭৩, ২০০৯ |)

লর্ড মেকলের শিক্ষানীতির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সবচেয়ে কম অর্থ ব্যয়ে ইংরেজ শাসনকে সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে এমন গুটিকতক ভারতীয়কে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা| অবশিষ্ট বিপুল সংখ্যক জনসমষ্টির শিক্ষার প্রয়োজন স্বীকৃত হয় নি, অর্থাৎ সমাজকে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত, এই দুটি পরিষ্কার ভাগে ভাগ করা হয়েছে| প্রধানত কেরানীকুল সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য, যারা ইংরেজ শাসকদের তাবেদারি করবে| এই শিক্ষাব্যবস্হায় একজন ভারতীয় নাগরিকের মেধা সৃষ্টি বা পুষ্টির কোন অবকাশ নেই| একজন ভারতীয়ের পক্ষে একটি বিদেশী ভাষা সাম্যক বা যথোচিত আত্মস্হ করা সম্ভব হয় না| তাই, উচ্চতর(বারো ক্লাসের পরবর্তী) শিক্ষায় আমরা একান্তভাবে ইংরেজি নির্ভর হয়ে পড়ি ও মুখস্ত করি| সেখানে মাতৃভাষার কোন স্হান নেই| মুখস্থ শক্তি দ্বারা বিশ্বের জ্ঞানসমুদ্র থেকে মণিমুক্তো আহরণ করার চেষ্টা করি| তাদের নিজের করে নিতে পারি না| তাই আমাদের গবেষণায় আজও যথেষ্ট স্বকীয়তার অভাব থেকে যায়, মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে কদাচিৎ আমাদের অবদান পরিলক্ষিত হয়| মেধাশক্তিতে আমরা পিছিয়ে পড়ি| প্রশ্ন জাগে, তাহলে আমাদের কর্তব্য কি? এক কথায় এর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, যদিও আমাদের মণীষীরা বিগত শতাব্দীতে বারে বারে, বিভিন্নভাবে এর উত্তর দিয়ে এসেছেন| এখানে, এই বিষয়ে আমরা আমাদের মতামত সংক্ষেপে প্রকাশ করব|

মাতৃভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম

 মানুষ সমজবদ্ধ জীব| সমাজে থাকতে হলে অহরহ বা  প্রতিনিয়ত আমাদের মনের সঠিক ভাব প্রকাশের জন্য বা আদান-প্রদানের জন্য ভাষার প্রয়োজন| চিন্তা করতেও ভাষা চাই| এমন কি স্বপ্ন দেখতেও ভাষা চাই|  তাই আমাদের জীবনে ভাষার গুরূত্ব অপরিসীম এবং মাতৃভাষার স্হান সবার উপরে| আমাদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় মাতৃভাষার মাধ্যমে|

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় যে নবজাগরণ হয়েছিল, সেই সময়কার মণীষীরা শিক্ষা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে গেছেন ও আমাদের কর্তব্য নির্দেশ করে গেছেন| বিশেষ করে বলতে গেলে সর্বাগ্রে মনে আসে স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধির নাম| এঁদের প্রত্যেকেই দেশের আপামর জনসাধারনের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অবৈতনিক আবশ্যিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করার কথা একাধিক বার বলেছেন| এই রকম শিক্ষা আবশ্যিক ও অবৈতনিক হওয়া চাই|

প্রসঙ্গত, অনেকে বলবেন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা, যিনি ইংরেজি ভাষা শেখার কথা বলেছেন| তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে জ্ঞানবিজ্ঞান ও টেকনোলজির যে বিরাট অগ্রগতি তখন ইয়োরোপে চলছিল তা থেকে জ্ঞান অহরণ করা ও দেশের সার্বিক উন্নতি সাধন| বাংলার আপামর জনসাধারন, বিশেষ করে শিশুরা যাতে বাংলা ভাষা সহজে ও সঠিকভাবে শিখতে পারে সেই উদ্দেশ্যে তিনি বর্ণপরিচয় রচনা করেন| ছেলেমেয়েদের চরিত্রগঠনের সহায়ক নানা আখ্যানমঞ্জরী রচনা করেন| বাংলা গদ্যসাহিত্যের জনক ঈশ্বরচন্দ্র এতেই থেমে থাকেন নি| নারীশিক্ষায় তিনি সঞিয় উদ্দ্যোগ গ্রহণ করেন| সবাই মাতৃভাষা ও ইংরেজি, উভয় ভাষাই শিখুক সেজন্য তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না|

শিক্ষা নিয়ে সুদীর্ঘকাল চিন্তাভাবনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ| নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন ও শান্তিনিকেতনে স্বীয় চিন্তাভাবনা কর্মে রূপান্তরিত করেছেন| একাধিক প্রবন্ধে, একাধিক বক্তৃতায় তিনি মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করার কথা বলেছেন| তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, শিক্ষার মাধ্যমরূপে মাতৃভাষার কোন বিকল্প হয় না| তাই উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অর্থাৎ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে বা মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে- সর্বত্র শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে মাতৃভাষা|

স্বাধীনতার সাত দশক পরেও কিন্তু উচ্চতর প্রথাগত ও কারিগরি শিক্ষা বা মেডিকেল, আইন ইত্যাদি শিক্ষাক্রমে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশে আমরা একান্তভাবে ইংরেজি ভাষার উপর নির্ভরশীল| অনেকের মনে হয়ত সন্দেহ জাগবে, ভবিষ্যতেও মাতৃভাষা আদৌ এই স্হান অধিকার করতে পারবে কিনা| বাংলা ভাষার মাধ্যমে উপরোক্ত উচ্চতর সমস্ত পর্যায়ে শিক্ষাপ্রদান, ও গবেষণা করা নিঃসন্দেহে একটা বিরাট কাজ- মাতৃভাষার প্রতি আমাদের ভালবাসাকে মূলধন করে দেশের বৃহত্তর নাগরিক সমাজকে এই কাজে চ্যালেঞ্জ মনে করে এগিয়ে আসতে হবে, এবং সবাই মিলে কাজ করতে হবে| অনেকে বলতে পারেন, ইংরেজি  দিয়েই তো বেশ চলছে, আবার মাতৃভাষা কেন? পরবর্তী অনুচ্ছেদে এই নিয়ে আলোচনা করব| ইংরেজি ভাষার উপর আমাদের নির্ভরতা হ্রাস করার কাজটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুরূহ|

মনে প্রশ্ন জাগে, শতকরা কতজন ভারতীয় নিজেদের চিন্তা ও মনের ভাব যথার্থরূপে ইংরেজিতে প্রকাশ করতে পারেন ও ইংরেজিতে প্রকাশিত চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন বা আত্মস্হ করতে পারেন? ১২৫কোটি ভারতীয় জনগণের কতজন ইংরেজি ভাষাকে নিজের করে নিতে পেরেছেন? উত্তর জানা নেই, তবে এই সংখ্যাটির শতকরা হার যে নিতান্ত নগণ্য বা ক্ষুদ্র সে বিষয় সন্দেহ করার অবকাশ নেই| এই নগণ্য সংখ্যক ছেলেমেয়ে, গবেষক বা শিক্ষকরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন| সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে পাস করা সেরা ছাত্রছাত্রীরা বিদেশে যাবার জন্য এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন| এই সব সেরারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর দেশে ফেরেন না বা ইচ্ছে থাকলেও ফিরতে পারেন না| অর্থাৎ আমাদের দেশের সেরা মেধাসম্পদ প্রতিবছর বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে,-দেশ সেই পরিমানে রিক্ত হচ্ছে| এই রিক্ততার প্রভাব আমাদের শিক্ষাঙ্গণের সর্বত্র দেখা দিচ্ছে|

শৈশবের ভাষা-

কয়েক দশক আগে পশ্চিমবঙ্গে, শিশুশিক্ষায় ভাষা নিয়ে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় এবং ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব কমনো হয়,- যার কুফল পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ভুগতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে|

ইংরেজি ভাষা সারা পৃথিবীতে আধুনিক কালের যোগাযোগের ভাষা রূপে স্বীকৃত| তাই কাজ চালানোর মত ইংরেজি ভাষা শেখা বাঞ্ছনীয়, কিন্তু শিক্ষার মাধ্যম রূপে নয়| ইংরেজি এবং মাতৃভাষা বাংলা, উভয় ভাষাই শিশুকাল থেকে যথোচিত যত্নসহকারে সুষ্ঠুভাবে শেখানোর ব্যবস্হা করা এবং নিয়মিত পরীক্ষা নিয়ে দেখা  দরকার ছাত্রছাত্রীরা ভাষাশিক্ষায় ঠিকমত এগোচ্ছে কিনা| শিশুর শিক্ষা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেছেন, শিশুপাঠ্য পুস্তক রচনা করেছেন এবং শিশুদের চরিত্রগঠনের উপর জোর দিয়েছেন| বর্তমান কালে ভারতে, শিশুদের চরিত্রগঠনের কোন শিক্ষা বা ব্যবস্হা নেই| সরকারিভাবে চরিত্রগঠনের জন্য শিক্ষার ব্যবস্হা করা সম্ভব নয়,- শিক্ষাকে যতদূর সম্ভব মুক্ত রাখা হয়েছে, অর্থাৎ শিশুদের স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়নি| মিশনারি স্কুলে বা কনভেন্টে কিন্তু খ্রিষ্টীয় ধর্মচিন্তার সঙ্গে নানারকম চরিত্রগঠনমূলক পাঠ বা ক্রিয়ার ব্যবস্হা থাকে| এই সব স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ, সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা এবং অন্যান্য সৎ গুণাবলি সম্বন্ধে বোধ অল্প বয়স থেকেই মজ্জাগত হয়ে যায়, যা সাধারণত বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলির ছাত্রদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না| বোধ হয় আমরা এই সব সৎ গুণাবলির বিশেষ সমাদর করি এবং আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই গুণগুলোর বিকাশ ঘটুক চাই, বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুলগুলোতে সচরাচর যা আমরা দেখতে পাই না| আমাদের ছাত্রদের মধ্যে এই সব গুণাবলি মজ্জাগত হলে হয়ত শিক্ষাঙ্গণে অশান্তি একটু কমত| পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাঙ্গণে শিক্ষার নামে যে উচ্ছৃঙ্খলা, গুণ্ডামি চলেছে তা আমরা চাই না| তাই আমাদের ছেলেমেয়েদের মিশনারি স্কুলে, কনভেন্টে বা নিদেনপক্ষে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করার জন্য এত হুড়োহুড়ি পড়ে যায়| অনেক সময়ে বিপুল পরিমাণ আর্থিক অনুদান বা ডোনেসন দিয়ে ভর্তি করাতেও আমরা পশ্চাৎপদ হই না|

বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মান এবং শিক্ষার সার্বিক মানের উন্নয়ন করতে গেলে যে বিষয়গুলির উপর আমাদের বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করা আবশ্যক তা এর পর আলোচনা করা হচ্ছে|

সর্বস্তরে শিক্ষার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম মাতৃভাষা

মেকলের শিক্ষানীতি অনুসরণের ফলে ভারতের তথাবাংলার সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে- ইংরেজিজানা কিছু ভদ্রলোক আর অবশিষ্ট বিপুল সংখ্যক অশিক্ষিত, যারা প্রায় সব ব্যাপারেই অবহেলার শিকার হন| স্বাধীনতার সাত দশক পরেও ছবিটা মোটামুটি একই রকমের রয়ে গেছে| তবে তথাকথিত অশিক্ষিতেরা আজ বুঝে গেছেন, সমাজে উঁচুতে উঠতে চাইলে ইংরেজি শেখা ছাড়া গতি নেই, ছেলেমেয়েদের ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করতে হবে| তাই ইংরেজি স্কুলে ভর্তির জন্য এত হুড়োহুড়ি| ভাল স্কুলের সংখ্যা বড় কম, নতুন ভাল বাংলামাধ্যম স্কুল তৈরির প্রচেষ্টা চোখে পড়ে না| আলোচ্য সমস্যাটি  সংক্ষেপে নিম্নরূপ:

  1. পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্হায় উচ্চতর বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, আইনবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ের শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি|
  2. আমাদের দেশের মণীষীরা বলেছেন, সর্বস্তরে শিক্ষার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম মাতৃভাষা| এর কোন বিকল্প নেই|
  3. ঊচ্চতর শিক্ষায় নিযুক্ত বা আগ্রহীদের মধ্যে, অতি ক্ষুদ্র এক অংশ ইংরেজিতে চিন্তাভাবনা করতে পারেন বা ইংরেজিতে প্রকাশিত চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন, যার ফলে আমরা মুখস্হ করায় জোর দিই, বা অনেক সময় আমদের গবেষণা মৌলিক হয় না| আমরা পিছিয়ে পড়ি, আর হাহূতাশ করি বিশ্বর সেরা দুশোটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আমাদের একটিও নেই|   

শিল্পোন্নত দেশগুলিতে ঊচ্চশিক্ষার মাধ্যম

ইয়োরোপে সুদী্র্ঘকাল শিক্ষাব্যবস্হা চার্চের কুক্ষিগত ছিল| শিক্ষার মাধ্যম ছিল ল্যাটিন বা গ্রীক ভাষা| জর্মানী, ফ্রান্স প্রভৃতি কয়েকটি দেশে শিক্ষার মাধ্যমরূপে মাতৃভাষা অষ্টাদশ বা ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রচলন করা হয়| ঐ সময়ের পর থেকে ঐ দেশগুলিতে বিজ্ঞান, কারিগরিবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে মৌলিক অবদানের জোয়ার আসে ও বিশেষ অগ্রগতি লাভ করে| ইংল্যাণ্ডে তুলনায় অনেক দেরিতে মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করা হয়| এই সময়ে দেখা যায়, ইংল্যাণ্ডের তুলনায় বিজ্ঞান, কারিগরি বিদ্যায় জর্মানী, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশ অনেক এগিয়ে যায়| এরপর, ইংল্যাণ্ডেও মাতৃভাষাকেও শিক্ষার মাধ্যম রূপে চালু করা হয়| শিক্ষার মাধ্যম ল্যাটিন থাকলে মাইকেল ফ্যারাডের[1] মত বিরাট বিজ্ঞানীকে কি : আমরা দেখতে পেতাম?

2.  বিগত শতাব্দীর শুরুতে জাপান মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান ও আবশ্যিক ও অবৈতনিক সা্র্বজনীন শিক্ষা চালু করে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি লাভ করে|

3. বেশিদিন আগের কথা নয়| চীন, সাউথ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ আবশ্যিক, অবৈতনিক সার্বজনীন মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান চালু করে এবং অভাবনীয় উন্নতি করে| দেশপ্রেম, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা এই সব দেশের বিশেষ গুণ|

4. আজ হোক কাল হোক, উন্নতি কোরে  উন্নত দেশের স্তরে পৌঁছতে হলে আমাদেরও, সর্বাগ্রে আবশ্যিক অবৈতনিক, মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষাপ্রদান ব্যবস্হা চালু করতে হবে| প্রায় দুশো বছরের পুরোনো, লর্ড মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্হাকে গতানুগতিক ভাবে টেনে নিয়ে গেলে চলবে না| উচ্চতর সমস্ত পর্যায়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের উপযুক্ত ব্যবস্হা করতে হবে| কাজটি কঠিন, কিন্তু সদিচ্ছা থাকলে অসম্ভব নয়|

সংশ্লিষ্ট কয়েকটি কথা

বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মান এবং দেশের সার্বিক মান উন্নয়ন করতে হলে উপরে আলোচিত ও সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিষয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মে রূপান্তরিত করা প্রয়োজন, কোন রকম কালবিলম্ব না করেই:

  1. সার্বজনীন ও অবৈতনিক সর্বসুবিধাযুক্ত প্রথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সারা দেশে চালু করতে হবে| দেখতে হবে একজন নাগরিকও যেন বাদ চলে না যায়| এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দে কোন কার্পণ্য চলবে না|
  2.  উচ্চতর শিক্ষা সমেত শিক্ষার সবকটি পর্যায়ে মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমরূপে গ্রহণ ও প্রয়োগ করতে হবে এবং একই সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষার চর্চা এবং গুরূত্ব কোনভাবেই হ্রাস করা চলবে না|
  3.  যথোপযুক্ত সমীক্ষা না করে নতুন কোন উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,- কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি, মেডিকেল, আইন, ম্যানেজমেন্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্হপন করা চলবে না| পাস করা ছাত্রদের মধ্যে কতজন কাজ পাচ্ছে তার উপর নির্ভর করবে নতুন উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্হাপন|
  4.  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বপ্রকার রাজনীতিমুক্ত রাখতে হবে| সরকারি হস্তক্ষেপ চলবে না| প্রসঙ্গত, ছাত্রসংসদের কর্তৃত্ব নিয়ে মারামারি তৎক্ষণাৎ বন্ধ করতে হবে| দরকার হলে সংসদের অনুমোদন পুনর্নবীকরণ করা হবে কি না বিবেচনা করতে হবে|
  5.  মনে রাখা দরকার, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষালাভ প্রত্যেক নাগরিকের জন্মগত অধিকার, কলেজি বা ঊচ্চতর শিক্ষা নয়| ঊচ্চতর শিক্ষায় কোনরকম সংরক্ষণ করা চলবে না, মেধাই একমাত্র বিচার্য| উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি অনুদানে মিতব্যয়ী হতে হবে| যথাসম্ভব, এইসব প্রতিষ্ঠানগুলির নিজস্ব খরচ নিজেদেরই চালাতে হবে| বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল, শিক্ষান্তে কর্মসংস্হান চাই|

প্রথম দুটি সুপারিশ কর্মে পরিণত করা বিশেষ কঠিন| এর জন্য যথোপযুক্ত পরিকাঠামো সৃষ্টি করতে হবে| প্রয়োজনীয় অর্থসংস্হান কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারকে করতে হবে| শিক্ষাকে প্রাপ্য অগ্রাধিকার দিলেই এটা সম্ভব| আর তৃতীয় সুপারি্শটির ক্ষেত্রে নানাধরণের অনভিপ্রেত চাপ আসতে পারে, বিশেষত রাজনৈতিক চাপ|

উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে কয়েক পুরুষধরে শিক্ষালাভ করে করে আমরা এতদূর অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে বাংলা বা মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে(কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি, মেডিকেল, আইন শিক্ষালয়ে) ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় পাঠাভ্যাস করা সম্ভব, সেটাই অনেকের কাছে বিস্ময়কর ঠেকবে|

একটি উদাহরণ

প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে B.Sc(Pass ও Honours) পঠন-পাঠনের স্বীকৃতি ও অনুমতি দেয়, অর্থাৎ ইচ্ছে করলে অধ্যাপকরা বাংলায় পড়াতে পারেন, পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে ইংরেজির

সঙ্গে বাংলা থাকবে এবং ছাত্ররা বাংলায় উত্তর লিখতে পারবে| এর জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলায় পুস্তক রচনার জন্য বিভিন্ন বোর্ড গঠন কোরে তাদের উপর উপযুক্ত পুস্তক রচনার দায়িত্ব দেন| বেশ উৎসাহের সঙ্গে অনেক অধ্যাপক পুস্তক রচনা করেন, বোর্ড মনোনীত বিশেষজ্ঞ দ্বারা সেই পাণ্ডুলিপি পরীক্ষা করে দেখার পর ছাপা হয়| প্রথম প্রথম বইগুলি ভালই চলছিল, ছাত্র ও শিক্ষকরা বইগুলির বেশ সমাদর করছিলেন| যে সব ছাত্ররা বাংলামাধ্যমে উচ্চমাধ্যমিক পড়েছে তাদের বেশ সুবিধে ও হচ্ছিল| কিন্তু কিছুদিন পর কিছু কিছু শিক্ষক বাংলায় পড়ানো পছন্দ করলেন না এবং ছাত্রদের বল্লেন, ইংরেজিতে পড় নাহলে চাকরি পাবে না| এই  সংবাদ জানার পর বহু ছাত্র, অসুবিধে সত্তেও বাংলা ছেড়ে ইংরেজিতে পড়াশুনা সুরু করে| আমাদের আক্ষেপ, শিক্ষার মাধ্যমরূপে মাতৃভাষার স্হান মাস্টারমশাইরা সঠিক অনুধাবন করতে পারলেন না! ইংরেজি অবশ্যই ভাল করে শেখা প্রয়োজন, কিন্তু শিক্ষার মাধ্যমরূপে নয়|  

উপসংহার

আলোচিত প্রস্তাবগুলি কাজে পরিণত করতে কি কি সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে, তা নিয়ে চিন্তা হল| সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে উচ্চতর শিক্ষায় মাতৃভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ| পুরূষাণুক্রম আমাদের কাছে ইংরেজি যে শ্রদ্ধার আসন লাভ করেছে বাংলা তা পায় নি| তাই আজও আমরা দৈনন্দিন জীবনে ইংরেজি মিশিয়ে বাংলা বলি, আমাদের বেশিরভাগ কাজকর্মে ভাষার দরকার হলে ইংরেজি প্রাধান্য পায়| আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের বড়একটা বাংলা শেখাই না| স্বদেশীযুগে যে দেশপ্রমের জোয়ার এসেছিল তা এখন নেই, অপরের জন্য কিছু করার কথা আমরা ভাবতে চাই না| এই মনোবৃত্তির পরিবর্তন দরকার| এর জন্য ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে দেশের প্রতি ভালবাসার মনোবৃত্তি আনতে হবে, ছাত্রদের বোঝাতে হবে যে বাংলায় মনের ভাব প্রকাশ করা কোন দুর্বলতা বা অজ্ঞানতার পরিচায়ক নয়| হয়ত এর জন্য যথোপযুক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে| নিঃসন্দেহে কাজটি কঠিন, কিন্তু দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য আবশ্যকীয়, এই বোধ সৃষ্টি হলে অসম্ভব নয়|

ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যে কি হবে? সেখানেও রাজ্যবাসী চাইলে রাজ্যের ভাষা উচ্চতর শিক্ষার মাধ্যমরূপে ব্যবহৃত হবে| আরও নানা খুঁটিনাটি এই বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তবে সেগুলি পরবর্তীকালে আলোচনা করলে চলবে| আর একটি গুরূত্বপূর্ণ বিষয় যা সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্হার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত তা হল, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে কঠোরভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ| সর্বত্র আবশ্যিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা চালু হলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়|


[1] Foot-note:  প্রথাগত কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ইনি পাননি, দরিদ্র পিতা তাঁকে ১২বছর বয়সে বই বাঁধাইয়ের কাজে লাগিয়ে দেন| যেসব পুস্তক বাঁধাইয়ের জন্য আসত, বালক ফ্যারাডে সময় পাওয়ামাত্র অসীম আগ্রহে তা পড়ে ফেলত এবং কৌতূহল নিরসন করার জন্য নানা চিন্তাভাবনা করত, প্রশ্ন করত| এই সময় বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক লর্ড কেলভিনের সঙ্গে তার দেখা, যিনি ওর মধ্যে প্রতিভা দেখতে পান, এবং নিজের ল্যাবে কাজ দেন|

—প্রদীপ নিয়োগী



Leave a comment