বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না
আজ থেকে ৩৩বছর আগে, প্রায় দুসপ্তাহের জন্য আমি সোভিয়েট দেশে গিয়েছিলাম| সেই যাত্রার স্মৃতিচারণ, যতটুকু মনে আছে এখানে লিখে রাখছি, ছেলে মেয়ে নাতি নাতনিদের জন্য| আর কেউ পড়তে চাইলেও আপত্তি নেই| আর দশটা স্মৃতিচারণ থেকে এটা একটু আলাদা ধরনের| “বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলেনা” এমন ঘটনা এর সঙ্গে জড়িত| একটু খোলসা করেই এখানে লিখব|
১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মকালে, কি কারনে মনে নেই, আমি একা খড়্গপুর থেকে কলকাতা এসেছি| হয়ত কোন Conference বা Seminar এ বক্তৃতা দিতে, বা অন্য কোন কাজে| আমি তখন IIT Kharagpurএ Mathematics এর Professor. সপরিবার থাকি IIT Campus এর দন্ডকারণ্য অঞ্চলে, দোতলা B-type বাড়ি B-83 তে| বিকেলের দিকে ভবানীপুরে এসেছি, কলকাতার কাজ শেষ হয়ে গেছে, পরের দিন সকালে খড়্গপুর ফিরে যাব| হঠাৎ রাস্তায় পুরোনো বন্ধু কমলের সঙ্গে দেখা| কুশল বিনিময়ের পর ও জানাল, “ইন্দিরা” সিনেমা হলে খুব ভাল একটা সিনেমা হচ্ছে| ও সেটি দেখতে এসেছে| ওর কাছে একটা বাড়তি টিকিট রয়েছে| আমাকে ওর সঙ্গে সিনেমাটি দেখতে অনুরোধ করল, এবং পীড়াপিড়ি সুরু করে দিল| অগত্যা, আমি ওর সঙ্গে সিনেমা দেখতে ঢুকলাম| ইভিনিং শো, রাত ন’টার আগেই
শেষ হল| কমল ওর বাড়ি চলে গেল| আমি ও সন্তোষষপুরে বাড়ি ফিরে যাব ভাবছি| পাশেই চার পাঁচটা বাড়ি পরে আমার দাদা, সুরেশপ্রসাদ নিয়োগীর ফ্ল্যাট, 12A/4 ইন্দ্ররায় রোড, স্ত্রী ও দুই কন্যা ঝুমু ও রূপুকে নিয়ে থাকেন| 1953 সাল থেকে 1961 সালের 5 জুলাই পর্যন্ত আমিও এই বাড়িতে থেকে B.Sc., M.Sc. পড়েছি ও তারপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের লেকচারার রূপে তিন বছর কাজ করেছি| অতঃপর এই বাড়ি থেকেই গবেষণা করতে, পশ্চিম জার্মানির আখেন সহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিই 1961 র 5 ই জুলাই| সে অন্য কথা| এখন যে কাহিনী বলছি, তাতে ফিরে যাই|
দাদার বাড়িতে ঢুকলে সন্তোষপুর যেতে রাত হয়ে যাবে| রাত্রে সন্তোষপুরের বাড়িতেই থাকব| রাত্রের খাওয়াও হয়নি, এই রকম সাত পাঁচ ভাবছি, আজ নাই গেলাম দাদার বাড়ি| আমি খড়্গপুর থেকে কলকাতা এসেছি, তাও ওরা জানে না| তখন মোবাইল ফোন আবিষ্কার হয় নি, খুব কম বাড়িতেই ফোন ছিল| চিঠিপত্র লিখে বা টেলিগ্রাম করে যোগাযোগ করতে হত| আবার ভাবলাম, একটু দেখা করেই যাই, বেশিক্ষণ বসব না| ভাবতে ভাবতে দাদার ফ্ল্যাটে উপস্হিত হলাম| কড়া নাড়তেই বৌদি দরজা খুললেন, দেখি খুব হাসছেন| ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম, হাসছ কেন? বৌদির উত্তর, তুমি আসছ তা আমরা জানি, দেখছিলাম আসতে কতক্ষণ লাগে| আশ্চর্য ব্যাপার, কি কোরে জানল আমি আসছি!
দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেই ডান দিকে দাদা বৌদির ঘর| সেই ঘরে একটা ডবল খাট আর মেঝেতে ফরাসের উপর আসন পেতে মাঝবয়সী মোটাসোটা শ্যামবর্ণ অপরিচিত এক ভদ্রলোক, ধুতির উপর হাফসার্ট পরা, বসে আছেন| বৌদি আলাপ করিয়ে দিলেন দেবুদা বলে এবং প্রণাম করতে বললেন| প্রণাম করে, একটু বিস্মিত হয়ে দেবুদার সামনে বসলাম| দাদাও ছিলেন ঐ ঘরে| একথা সেকথার পর দেবুদা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বিদেশ যাচ্ছ কবে? বললাম, বিদেশ যাবার তো কোন কথা নেই, কোন চেষ্টাও করছি না, কোথাও apply ও করিনি| উনি বললেন, তুমি শিগগিরই যাবে| যেখানে যাবে, সেখান থেকে তোমার দাদার জন্য একটা টেপ-রেকর্ডার নিয়ে এস| শুনে আমার খুব হাসি পেয়ে গেল, যেন “হাওয়া মে বাত”| বললাম, আগে যাই তো, তারপর দেখা যাবে| ওঁর কথা বিশ্বাস করছিনা দেখে উনি একটু থেমে বললেন, আজ থেকে ১১৩ দিনের মাথায় তুমি বিদেশ যাবে, বেশিদিন থাকবে না| তোমার মঙ্গল হোক|
পরের দিন খড়্গপুর ফিরে এলাম| বুলু, আমার স্ত্রীকে বললাম দেবুদার কথা| ও কোন পাত্তা দিল না| আমার দাদা বৌদি সাধন-ভজন নিয়ে মেতে থাকতেন| বাড়িতে নানা সাধু সন্ন্যাসী আসতেন, থাকতেন| তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতাম না| এঁদের দৈব শক্তি থাকলেও থাকতে পারে| তবে, দেবুদাকে দেখে তো গৃহী মনে হল| যাই হোক, এই নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করব না| নিজের কাজে মন দিলাম|
চার পাঁচ দিন পরে হঠাৎ একটা টেলিগ্রাম পেলাম, Indian Institute of Science, Bangalore এর Aeronautics এর প্রফেসর Roddam Narasimha র কাছ থেকে|(পরবর্তী কালে ইনি F.R.S হন|) দীর্ঘ টেলিগ্রাম| মূল বক্তব্য হল:
USSR Academy of Science এর Invitation এ INSA(Indian National Science Academy) সোভিয়েট দেশে একটা Delegation পাঠাচ্ছে| বিষয় Continuum Mechanics, পাঠাচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসে| এই delegation এ যাবার জন্য delegation এর Chairman, Prof Narasimha আমাকে invite করছেন| Moscow তে Lab. Visit, দুদেশের বিজ্ঞানী ও ইন্জিনিয়রদের মধ্যে latest development বিষয়ে আলাপ আলোচনা হবে| আর একটা symposium হবে, সেখানে আমাদের গবেষণা সংক্ষেপে উপস্হাপিত করতে হবে| আশা করি, আমি আমার সম্মতি অবিলম্বে জানাব| যাতায়াত ভাড়া, থাকা খাওয়ার খরচ সবই USSR Academy of Science এবং INSA বহন করবে| visa র ব্যবস্হা ও ওরাই করবে, আমাকে ছুটোছুটি করতে হবে না| প্রধান কাজ হবে আমার নিজের গবেষণার উপর একটা বক্তৃতা তৈরি করা|
“এ তো দেখি মেঘ না চাইতেই জল”! দেবুদার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলতে চলেছে| INSA র সদস্যদের বলা হয় FNA, যারা সারা ভারতে ছড়িয়ে রয়েছেন| উচ্চ মানের গবেষণার স্বীকৃতি হল FNA হওয়া| আমি FNA নই| আমাদের iit, খড়্গপুর এর গণিতের অধ্যাপক অনাদিশঙ্কর গুপ্ত, (Prof A.S. Gupta) FNA এবং নামকরা বিজ্ঞানী| তাঁর ও বিষয় Continuum Mechanics. এরকম রথী-মহারথীদের বাদ দিয়ে
আমাকে invite করা খুবই বিস্ময়কর! আর দেবুদাই বা আগে থাকতে জানতে পারলেন কি কোরে? ইতিপূর্বে উনি আমাকে কখনো চোখে দেখেন নি| এ এমন একটি ঘটনা, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না!
এর পরের অংশ হল, দিন দশ বারো সোভিয়েট দেশে ভ্রমণ, বিখ্যাত বিজ্ঞানিদের সঙ্গে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলাপ-আলোচনা, অন্য দশটা conference বা symposium এ যোগ দিলে যেমনটা হয় অনেকটা সেই রকম, যদিও হঠাৎ হঠাৎ কিছু ব্যতিক্রম বা চমকের সম্মুখীন হয়েছি| নতুন দেশে যাচ্ছি, ভাষা অজানা, আচার-ব্যবহার রীতিনীতি আলাদা, আর ওদের কাজকর্মের মধ্যে অনেক কিছুই তো প্রকাশ্যে আসে না বা আমরা জানতে পারি না| তাই সব মিলিয়ে একটু উৎকণ্ঠা ছিলই|
আট জন বিজ্ঞানী বা ইন্জিনিয়র ছিলেন আমাদের delegation এ বা দলে| বিশেষ অসুবিধে থাকায় অধ্যাপক নরসিমহা আমাদের সঙ্গে যেতে পারেন নি| তাঁর পরিবর্তে দলের চেয়ারম্যান হলেন, রূড়কি ইন্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যাপক N.C. Nigam, যিনি পরবর্তিকালে IIT Delhi র ডিরেক্টর হয়েছেন দুবার| ওঁর গবেষণার বিষয় Seismology বা প্রধানত ভূমিকম্প| এছাড়া ছিলেন IIT Madras এর Aeronautical engineering এর অধ্যাপক টি.কে. বাসু, যাঁকে আমি আগে থাকতে চিনতাম, জার্মানিতে থাকার সময়| উনি জার্মানিতে পড়াশুনা করেছেন এবং Thermodynamics ও Fluid dynamics এ গবেষণা করেছেন, কিছুদিন Cal. Tech.(California Institute of Technology) এ গবেষণা করেছেন| আর বাকিরা IISC ব্যাঙ্গালোর এর অধ্যাপক আয়েঙ্গার, IIT Kanpur এর মেকানিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং এর অধ্যাপক সিং ইত্যাদি| এতদিন পরে সবার নাম ও ভাল কোরে মনে নেই|
যেমন, রূড়কি থেকে একটু বয়স্ক, civil engineering এর অধ্যাপক ছিলেন, নাম এখন সঠিক মনে নেই, বোধ হয় ডঃ শর্মা| দলের অন্যদের বয়স চল্লিশের কোঠায়| সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে উচ্চ মানের গবেষণা করেছেন|
গোছগাছ করে, বক্তৃতা তৈরি করে রওনা দিলাম| কলকাতা থেকে ১৩ই সেপ্টেম্বর, Air India র বিমানে সন্ধ্যাবেলা রওনা হলাম, দিল্লি পৌঁছলাম রাত দশটা নাগাদ| রাতটা থাকলাম Centaur হোটেলে, Air India র সৌজন্যে ও ব্যবস্হাপনায়| পরের দিন সকালে দিল্লি থেকে মস্কোর flight ধরতে হবে| হোটেলটি পাঁচ-তারা| এর আগে কখনও আমি কোন পাঁচ-তারা হোটেলে থাকিনি| আমাকে যে ঘরে থাকতে দিল সেটি একটি সুন্দর সুসজ্জিত ঘর| সব কিছু বিশেষভাবে disinfectant দিয়ে germfree করা হয়েছে| যেমন, জল খাবার গ্লাস গুলো কাগজে মোড়া, এমনকি টয়লেটের সিটকভার ও সযত্নে কাগজে মোড়া| একটু কেমন যেন অস্বস্তি অস্বস্তি লাগছে| প্লেনে ডিনার দিয়েছিল, তাই শুধু এক কাপ কফি খেয়ে শুয়ে পড়লাম, ভোর সাড়ে চারটের সময় জাগিয়ে দিতে বললাম| ঘুম আসছিল না| ভোরের দিকে যখন সবে একটু ঘুমিয়েছি তখন এল waking call. এক কাপ চা খেয়ে তৈরি হয়ে নিলাম| যথাসময়ে Air India র গাড়ি হোটেল থেকে airport পৌঁছে দিল| মালপত্র বলতে একটা স্যুটকেস আর একটা ব্রিফকেস| ব্রিফকেসটি দেখতে সুন্দর, আমেরিকা থেকে আমার ছোট ভাই মন্টু নিয়ে এসেছিল| ভাবছিলাম দিল্লি airport এ আমাদের দলের অন্যদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হবে| তা হোল না, হাতে সময় নেই বলে| মস্কোর উদ্দেশ্যে প্লেন ছাড়ল| প্লেনে ব্রেকফাস্ট দিল| মস্কো পৌঁছে গেলাম, ওখানকার সময় দুপুর ১২টা নাগাদ, ওখানকার তাপমাত্রা 12 ডিগ্রি সেলজিয়াস|
স্যুটকেস নিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম, মালপত্র X-ray দিয়ে চেক করে airport থেকে বের হতে দিচ্ছে| বেশ লম্বা লাইন| সবাই বলাবলি করছে, অনেক দিন পরে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে| বোধহয় ভারতীয়রাই সূর্যকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে| লাইনে অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না| একটু পরেই এক ভদ্রলোক এসে, আমাদের দলের সবাইকে ডেকে একসাথে করে, airport এর বাইরে নিয়ে এলেন, মালপত্র চেক না করেই| বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছিল| আমাদের নিয়ে গেল USSR Academy of Science(বা সংক্ষেপে Acad. Sc.) এর Guest House এ . সেখানে আমাদের জন্য ঘর বুক করা ছিল| বেশ বড় পাঁচতলা বাড়ি, যদিও খুব একটা বিলাসবহুল নয়| পাশের বাড়িটিও আর একটা গেষ্টহাউস, তবে সেটা দেশি(অর্থাৎ ussr এর নাগরিক) অতিথিদের জন্য, কৌলিন্য কিছুটা কম| আমরা বিদেশী, তদুপরি vip, যে জন্য airport থেকে বেরোবার সময় আমাদের মালপত্র চেক না কোরেই বেরোতে দিয়েছে| ওদেশে যে কয়দিন ছিলাম, বারে বারে লক্ষ্য করেছি, Acad. Sc. নামটি বিশেষ সম্ভ্রমের উদ্রেক করে, বিশেষত Academician অর্থাৎ যাঁরা Academy র সভ্য তাঁরা যেন demi-god অর্থাৎ ভগবৎতুল্য| Academician নন এমন অধ্যাপক রাও বিশেষ সম্মানের অধিকারী| যেহেতু Acad.Sc. আমাদের নিমন্ত্রণ কোরে এনেছে তাই আমরাও এক একজন VIP.
প্রকৃতপক্ষে, ওদেশে সর্বত্র আমরা যে সম্মান লাভ করেছি, তা ভারতে দুর্লভ| এই সময়ের দুই দশক পূর্বে, গবেষণার কাজে, আমি চার বছর পশ্চিম জার্মনিতে ছিলাম| সেখানেও লক্ষ্য করেছি, অধ্যাপকরা যেন demi-god. “স্বদেশে পুজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পুজ্যতে,” – ussr এবং জার্মানিতে এই নীতিকথা যেন বিমূর্ত রূপ ধারণ করেছে| বিদ্যাকে ভাল না বাসলে, সম্মান না করলে সেখানে সরস্বতীর অধিষ্ঠান হয় না!
গেষ্ট-হাউসের যে যার ঘরে ঢুকে একটু fresh হয়ে নিলাম| তারপর আমরা গেলাম মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে| সেখানে কয়েকজন অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল| দেখতে দেখতে আড়াইটে বেজে গেল| বেশ ক্ষিদে পেয়ে গেছে| ইউনিভার্সিটি ক্যান্টিনে লাঞ্চ করলাম, সবাই মিলে, ছাত্রদের সাথে| সাহেবরা দেখলাম বেশ পেট ঠেসে খেলেন| খাওয়া শেষ করে সবাই মিলে হেঁটে আমরা গেলাম, মাইল খানেক দূরে Lomonosov University দেখতে| বেশ খোলামেলা প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে চলেছি, ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে| একটু পরে রীতিমত শীত করা শুরু হয়ে গেল| আমার গায়ে যথেষ্ট গরম জামা, এমন কি সামার-কোট(গ্রীষ্মকালের উপযুক্ত হালকা ওভারকোট) ও পরে আছি, তাও যেন ঠাণ্ডা লাগছে, মাঝে মাঝে কাঁপুনি ও হচ্ছে| দূর থেকেই ইউনিভার্সিটি দেখলাম| খুব impressive ১৮ তলা বিশাল বাড়ি| একটু ঘুরেই হেঁটে গেষ্ট-হাউসে ফিরে এলাম| শীত করছে, কাঁপুনি থামছে না|
এখানে আসার আগে আমার সহপাঠী ও দীর্ঘদিনের সুহৃদ অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর কাছে মস্কোতে কেমন ঠাণ্ডা জানতে চেয়েছিলাম| ও মস্কোতে প্রায় চার বছর প্লাজমা ফিজিক্স বিষয়ে গবেষণা করেছে, বিখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক ভ্লাসভের কাছে| ও বলল, সেপ্টেম্বর মাসে ঠাণ্ডা পাবে না| তবে মাঝে মাঝে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা হাওয়া বয়, সরাসরি সাইবেরিয়া থেকে হাওয়া আসে| রাশিয়ান ছেলেমেয়েরা ঠাণ্ডা খুব পছন্দ করে, এমন কি মাইনাস ৪০ডিগ্রিতে ও আইসক্রিম খায়|
কাঁপুনিটা তাহলে সাইবেরিয়ার হাওয়ার কল্যাণে হচ্ছে! মনে হল এক গ্লাস বিয়ার বা ব্র্যাণ্ডি খেলে হয়ত কাঁপুনি কমতে পারে| গেষ্ট-হাউস থেকে বেরিয়ে, সামনের ফুটপাথ ধরে হাঁটা দিলাম| আশ্চর্যের ব্যাপার ১৫/২০ মিনিট হেঁটেও কোন বিয়ার-পাব বা কোন মদ্যপানের জায়গা চোখে পড়ল না| অতি প্রশস্ত রাস্তা, বিশাল বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি রাস্তার দুপাশে রয়েছে| তাড়াতাড়ি গেষ্টহাউসে ফিরে এলাম এবং কেয়ার টেকার মহিলাকে ব্যাপারটা বললাম| ইনি এক বর্ণও ইংরেজি বোঝেন বলে মনে হল না| অন্য এক ভদ্রলোক, যিনি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, সাহায্য করতে দাঁড়িয়ে পড়লেন| ইনি রাশিয়ান অল্প বলতে পারেন| আমি শুধু একটা রাশিয়ান শব্দ শিখেছি| তা হল “piba” অর্থাৎ বিয়ার| যাই হোক, আমি কি চাই ভদ্রমহিলা বুঝলেন এবং বললেন, ৬টার পর এই গেষ্ট-হাউসের নীচ তলার রেস্তোরা খুলবে| সেখানে তুমি বিয়ার বা ব্র্যাণ্ডি যা চাও পাবে| বাইরে alcoholic drink বিক্রি নিষিদ্ধ, কিন্তু এই গেষ্টহাউসে বিদেশিদের জন্য নিষিদ্ধ নয়| পরে জেনেছি, রাশিয়ানরা ইচ্ছেমত মদ খেয়ে মাতলামি করত, কয়েকজন মারা ও গেছে| তাই প্রসিডেন্ট গর্বাচভ প্রকাশ্যে এই জাতীয় পানীয় খাওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন| অবশ্য, দোকান থেকে কিনে বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই|
গেষ্টহাউসে temperature দেখলাম ৫ডিগ্রি সেলসিয়াস, অর্থাৎ তিন চার ঘণ্টাতেই বেশ নেমে গেছে| সন্ধ্যাবেলা ডিনারের সঙ্গে বিয়ার নিলাম এবং ধীরে সুস্হে খাওয়া শেষ করে ঘরে ফিরে এলাম| কাঁপুনি নেই, কিন্তু ঘরে তাও শীত করছে| রাত্রে কম্বল গায়ে দিয়েও শীত যেন যাচ্ছে না| সেন্ট্রাল হিটিং চলছেনা কেন, জিজ্ঞেস করে জানলাম, তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নীচে না যাওয়া পর্যন্ত সেন্ট্রাল হিটিং চালানো হয় না| যাই হোক, পরের দিন থেকে ঠাণ্ডা আর তেমন পীড়াদায়ক মনে হয় নি|
পরের দিন সকালে গেষ্টহাউসের খাবার হলে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করলাম| খাবার সাজানো রয়েছে, ইচ্ছেমত প্লেটে তুলে নাও আর খাও| জিনিসপত্রের দাম ও লেখা রয়েছে দেখলাম| পাউরুটি, মাখন, জ্যাম, চিজ, নিতান্তই সস্তা| তুলনায় সসেজ ও অন্যান্য মাংসের খাবার বা ফল বেশ দামি| রান্না করা খাবার ও দামি| সাহেবরা দেখলাম প্রচুর মাখন আর সসেজ খাচ্ছে|
ব্রেকফাস্টের পর আমরা বেরোলাম মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ল্যাব visit করতে, কি ধরনের গবেষণা হচ্ছে, ইত্যাদি টেকনিক্যাল আলোচনা, দুচারজন অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ আলোচনা, এই করতে করতেই সারাদিন কেটে গেল| শীত নিয়ে ভাবার সময় পেলাম না| পরের দিন ছিল ঘুরে বেড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট অর্থাৎ মস্কো ও আশেপাশের দ্রষ্টব্য দেখা| মস্কোতে এত কিছু দেখার আছে যে একদিন কেন সাতদিনেও দেখে শেষ করা যায় না| প্রথমেই ক্রেমলিন এবং রেড স্কোয়ার| বিশাল জায়গা, বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্ট্যাচু চারপাশে| ক্রেমলিন ভবনে অবশ্য ঢোকা নিষেধ| জারদের প্যালেস, সঙ্গে একাধিক গির্জা এবং ক্যাথিড্রাল| অক্টোবর বিপ্লবের পর ওদেশে ধর্মচর্চা নিষিদ্ধ হয়, চার্চে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়| কম্যুনিষ্টরা ভগবানে বিশ্বাস করে না, বা ওদেশে ধর্মীয় অভ্যাস, আচার আচরণের নির্বাসন ঘটেছে| আমরা মিউজিয়াম দেখতে খুব একটা আগ্রহী নই| তাই বেশি মিউজিয়াম দেখতে যাই নি| তাও সারাদিন ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় গেষ্টহাউজে ফিরে এলাম| আমাদের মস্কো ভ্রমণ আপাতত এখানেই শেষ| পরের দিন আমরা যাব তাসখন্দ বা Tashkent এ| সকালে ব্রেকফাস্ট কোরে বেরোব| ওখানে আমরা কয়েকদিন থাকব| ওখানে একটা Symposium হবে Continuum Mechanics এর উপর| আমরা আমদের কাজ present করব| সোভিয়েট বিজ্ঞানীরা উপস্হিত থাকবেন, বক্তৃতা করবেন, আলাপ আলোচনা করবেন| আমাদের পাসপোর্ট ওরা আগেই নিয়ে নিয়েছিল এবং তাসখন্দের জন্য প্রয়োজনীয় Visa র ব্যবস্হা কোরেছিল| কোলকাতা থেকে আমাকে যে Visa দিয়েছিল, তা শুধু মস্কোর জন্য, অন্য কোন সোভিয়েট রাজ্যে যেতে হলে আলাদা ভিসা চাই| পার্থক্যটা চোখে পড়ার মত| যেমন, USA র ভিসায় সমগ্র USA র যে কোন জায়গায় যাওয়া যায়, সোভিয়েট দেশে কিন্তু তা নয়|
পরের দিন সকালে তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে তাসখন্দ যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলাম| যথাসময়ে ওরা গাড়ি করে আমাদের airport নিয়ে গেল| এখানে আমাদের জন্য একটু চমক অপেক্ষা করছিল| আমাদের গাড়িগুলো সরাসরি aircraft পর্যন্ত চলে গেল এবং আমরা সোজা প্লেনে উঠে পড়লাম, কোন রকম চেকিং ছাড়াই| তখনই বুঝলাম আমরা VIP, মালপত্র বা security র body-search কিছুই করতে হল না! মস্কো থেকে তাসখন্দ যেতে ঘন্টা তিন চার লাগল| তাসখন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেষ্টহাউসে আমাদের থাকার ব্যবস্হা হোল| মোটামুটি ভাল ব্যবস্হা, পাশাপাশি ঘর| আমাদের দলের অন্যদের সঙ্গে ভাল কোরে চেনা জানা এখানেই হল|
–প্রদীপ নিয়োগী


Leave a comment