বাল্যস্মৃতি: জনৈক উদ্বাস্তু বালকের কাহিনী
আজ থেকে ৬৮ বছর আগে আমার জীবনে এবং আমাদের পরিবারের জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা আমাদের সকলের জীবনকে ওলট পালট ও লন্ডভন্ড করে দিয়েছে| তারই বিবরণ, সংক্ষেপে, যেটুকু মনে আছে, এখানে লিখে রাখছি আমার ছেলেমেয়ে নাতি নাতনিদের জন্য| তারা জানবে কেমন ছিল আমাদের জীবন|
২৩শে মার্চ ১৯৫০ সালে, তখনকার পূর্বপাকিস্তানের ময়মনসিংহ সহর থেকে একবস্ত্রে রওনা হয়ে ২৪শে মার্চ, ১৯৫০ আমরা কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে এসে পৌঁছাই মধ্যরাতে, প্রায় রাত একটা নাগাদ| আমাদের পরিচয় উদ্বাস্তু| কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে আমাদের কোন বাড়ি বা ভিটে ছিল না| আমরা বলতে বাবা, মা, মেজদা(শীতেশ), সেজদা(শিবেশ), দিদি(দীপালি), আমি(প্রদীপ), মন্টু(দীপক) ও জয়ন্ত,- এই আট জন| ময়মনসিংহ সহরে কলেজ রোডে ভাড়া বাড়িতে আমরা থাকতাম, সম্ভবতঃ ১৯৪২ সাল থেকে সুরু কোরে| তার আগে ছিলাম কাছেই আর একটা ভাড়া বাড়িতে, জমিদার কেশববাবুর বাঙলো বাড়িতে| বাড়িটায় বেশ ফলের বাগান ছিল| দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ARP(Air Raid Precaution) বাড়িটির দখল নেয়| সেই সময় জাপানিরা কলকাতায় বোমা ফেলেছিল ও পরের বছর কুখ্যাত “পঞ্চাশের মন্বন্তর” হয়েছিল,- সে অন্য কাহিনী|
কলেজ রোডের বাড়িটিতে আমরা আট বছর ছিলাম| বাবা সুরেন্দ্রপ্রসাদ নিয়োগী, সংস্কৃত ও বাংলায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডবল এম.এ., ব্রিলিয়ান্ট স্কলার, ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে সংস্কৃত ও বাংলার অধ্যাপক ছিলেন| ময়মনসিংহে আসার আগে বাবা মেদিনীপুর কলেজে বছর খানেক অধ্যাপনা করেছেন| তার আগে ১০/১২ বছর যশোর জেলার নড়াইল কলেজে অধ্যাপনা করেছেন| নড়াইলেই আমাদের ভাই বোনদের জন্ম| আমার জন্ম ১৯৩৫ সালের ৮ই জুলাই(২৩শে আষাঢ়)| আমরা ভাইরা ময়মনসিংহের মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে পড়াশুনা করেছি( জয়ন্ত ছাড়া- ও খুব ছোট ছিল)| আর দিদি পড়ত আমার এক ক্লাস উঁচুতে বিদ্যাময়ী স্কুলে| দাদা(আমার সবচেয়ে বড় ভাই সুরেশপ্রসাদ) ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ও আনন্দমোহন কলেজ থেকে I.A. পাস করেন ১৯৪৬ সালে, ফার্স্ট ডিভিসনে| B.A. তে ভর্তি হন রাজসাহী Govt. কলেজে Economics Honours নিয়ে হস্টেলে থেকে পড়াশুনা করতেন| পরবর্তী কালের প্রখ্যাত চলচিত্রকার ঋত্বিক ঘটক এখানে দাদার সহপাঠী ছিলেন, থাকতেন একই হস্টেলে, রুমমেট ও ছিলেন হয়ত| আমার বাবা ও এক সময়ে এই রাজসাহী Govt. college এ B.A. পড়তেন, সুদীর্ঘকাল আগে| এটি খুব ভাল নামকরা কলেজ ছিল| ১৯৪৭ এর ১৫ই অগাষ্ট, ভারত স্বাধীন হবার পর দাদা কলকাতা চলে আসেন| থাকেন গড়পার রোডে বাবার মামাত দাদার(রমেশ নিয়ো্গী) বাড়ি| সে বাড়িতে অনেক ভাই বোন ছিল| দাদা সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হন, যদিও চাইলে প্রেসিডেন্সি কলেজে Economics Honours নিয়ে ভর্তি হতে পারতেন| সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকেই ১৯৪৮ সালে B.A.(Hons) পাস করেন, 2nd class. সে সময়ে Hons. এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কদাচিৎ এক আধজন ফার্স্টক্লাস পেতেন| পাস কোরে দাদা চাকরি নেন Bengal National Chamber of Commerce এ librarian পদে| থাকতেন মনোহর পুকুর রোডে একটা বাড়িতে মেস কোরে|
আমরা সবাই ময়মনসিংহের কলেজ রোডের বাড়িতে থাকতাম| বাড়িটি আনন্দমোহন কলেজের খুব কাছে, গলির মধ্যে| দুটো শোবার ঘর, একটা বসার ঘর, একটা বাইরের ঘর, তার সঙ্গে লাগোয়া ঠাকুর ঘর, রান্নাঘর, বারান্দা মিলে একটা আলাদা বাড়ি যেন, মূল অংশ থেকে ৬/৭ ফুট দূর| পায়খানা, স্নানের ঘর একটু দূরে, মাঝে উঠান যেখানে কিছু গাছ ছিল, যেমন একটা সুপারি গাছ, একটা কাঁঠাল গাছ, একটা পেয়ারা গাছ অল্পস্বল্প ফুলের গাছ| আর ছিল একটা টিউবওয়েল| বর্ষাকালে পায়খানা/বাথরুমে যেতে একটু সমস্যা হোত কারন সাপ দেখা যেত| সাধারনত বিষাক্ত সাপ| পায়খানাটি পুরনো আমলের খাটা পায়খানা| দুতিন দিন অন্তর অন্তর জমাদার এসে ময়লা পরিষ্কার করে নিয়ে যেত| পায়খানাটি একটু উঁচু ছিল, মাটিতে রাখা মাটির গামলায় পায়খানা উপর থেকে পড়ত|
বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না| সন্ধ্যাবেলা লন্ঠন জ্বালাতে হোত| মা রাত্রে রান্নার কাজ করতেন কুপি জ্বালিয়ে| দু তিনটে লন্ঠন যা ছিল সেগুলো আমাদের পড়ার জন্য লাগত| মাটিতে মাদুর/সতরঞ্চি পেতে মধ্যিখানে লন্ঠন রাখা হোত, আমরা গোল কোরে চারপাশে বসতাম| যতদিন দাদা ময়মনসিংহে ছিলেন, বাইরের ঘরে থাকতেন, একটা লন্ঠন লাগত| দাদা রাজসাহী চলে যাবার পর সেজদা ঐ ঘর দখল করেন| অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করতেন লন্ঠন জ্বালিয়ে| অনেক সময় বাইরের ঘরের বারান্দায় লন্ঠন ঝুলিয়ে সেই আলোয় পড়তেন, ঘুরে ঘুরে জোরে জোরে চিৎকার কোরে, হয়ত বা পড়া মুখস্হ করতেন| সেজদা পড়াশুনায় খুব ভাল ছিল,-ক্লাসের ফার্স্ট বয়| এক একটা ক্লাসে ৪/৫টা কোরে সেকসন ছিল| সব সেকসন মিলিয়ে ফার্স্ট হওয়া কিন্তু সোজা নয়| ১৯৪৮ সালে সেজদা ম্যাট্রিক পাস করে, চারটে বিষয়ে লেটার(৮০% বা তার বেশি) পেয়ে,- অঙ্ক, সংস্কৃত, ইতিহাস ও অ্যাডিশনাল অঙ্ক বিষয়ে লেটার| তখনকার দিনে কোন বিষয়ে লেটার পাওয়া এখনকার মত সোজা ছিল না| সেজদা স্কুলের বেশ বিখ্যাত ছাত্র ছিল| তারপর আনন্দমোহন কলেজে I.Sc. তে ভর্তি হয়| I.Sc. final পরীক্ষা ১৯৫০ সালের সম্ভবত জুন/জুলাই মাসে হবে| তার আগেই প্রবল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যে, ২৩/২৪শে মার্চ ১৯৫০, আমরা সব কিছু ছেড়ে, বলতে গেলে এক কাপড়ে প্রাণ হাতে কোরে স্বেচ্ছায় পালিয়ে কলকাতা চলে এলাম|
ময়মনসিংহ সহর ছিল হিন্দু প্রধান, যদিও গ্রামাঞ্চল ছিল মুসলমান প্রধান| মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা হিন্দু, নিম্নবিত্তরা মুসলমান| ভারত ভাগের আগে কে হিন্দু বা কে মুসলমান আমরা কখনও ভেবে দেখতাম না| স্কুলে আমাদর সহপাঠী বা খেলার সাথিদের মধ্যে মুসলমান বন্ধু বড় একটা ছিল না| পরিবর্তন এল ভারত ভাগের পর, বহু হি্ন্দু পরিবার পশ্চিমবঙ্গে চলে যান| অল্প কিছু মুসলমান পরিবার এপারে আসেন| আমরা শান্তিতেই ছিলাম|
১৯৫০ সালের সুরুতেই পূর্বপাকিস্তানে(তখন ও বাংলাদেশ হয় নি) সাম্প্রদায়িক গোলমাল, মারামারি খুনোখুনি সুরু হয়, বিশেষ করে ঢাকায় এবং বরিশালে| দলে দলে হিন্দুরা প্রাণভয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে, উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে সুরু করে| তুলনায় ময়মনসিংহে গোলমাল খুনোখুনি প্রায় ছিলই না| আমরা ওপারে যাই নি| আমাদের দেশ টাঙাইল, ময়মনসিংহ জেলার সাবডিভিশন| সেখানে লাঙ্গুলিয়া নদীর ধারে সদোপুর (সহদেবপুরের অপভ্রংশ) গ্রামে, আমার প্রপিতামহ গোবিন্দপ্রসাদ নিয়োগী বাড়ি তৈরি করেছিলেন| বেশ বড় পাকা বাড়ি, অনেকগুলো ঘর, দোতলা| সামনে প্রশস্ত ঠাকুরদালানে দুর্গাপুজো ও অন্যান্য পুজো হত| তখন ভাইবোনরা, ছেলেমেয়ে নাতি নাতনিরা সব আসতেন| দেশের বাড়ির প্রতি বাবার খুব টান ছিল, যদিও নানা কারনে আমাদের বড় একটা যাওয়া হয়ে উঠত না| বাবার কলকাতা যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না| আগে কলকাতায় অধ্যাপনার সুযোগ পেয়ে ও গ্রহণ করেন নি, যদিও M.A. পাস করার পর কলকাতায় কিছুকাল স্কুলে পড়িয়েছেন| কলকাতা ওঁর ভাল লাগত না| ভারত ভাগের পর পাড়াপড়শীরা সবাই এক এক কোরে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাচ্ছে দেখে মা যদি কলকাতায় চাকরির চেষ্টা করার কথা বলতেন, বাবা বলতেন, “ কি কামে মরতে কইলকাতা যাইবা? এখানে আমরা ভালই আছি|” ১৯৫০ সালের গোড়ায় পূর্বপাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে থাকে| “কলকতায় নাকি মুসলমান নিধন চলেছে, তারই বদলা|” তখন ও আমরা ভাবছি দাঙ্গা খুব শিঘ্রি থেমে যাবে| তাছাড়া, ময়মনসিংহ সহরে বিশেষ গোলমাল নেই| আর চাকরিহীন অবস্হায় ছয়/সাতটি ছেলেমেয়ে নিয়ে কলকাতায় কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?- এই রকম ছিল বাবার মনের অবস্হা|
ভাগ্যের পরিহাস, ময়মনসিংহে দাঙ্গার পরিস্হিতি খারাপ হতে লাগল, ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারী থেকেই| সন্ধ্যার পর রোজই বড় বড় সশস্ত্র, মশাল সহ মিছিল “আল্লাহো আকবর” ধ্বনি দিতে দিতে সহর পরিক্রমা করতে লাগল| আমাদের বাড়ির কাছেই মুসলমানদের বস্তি ছিল, আর অল্প কয়েক ঘর হিন্দু বসতি ছিল| বেশ ভয়ের পরিবেশ| রোজই খবর আসতে লাগল, আজ অমুককে ছুরি মেরেছে, তমুককে মেরেছে| মেয়েদের উপর অত্যাচারের খবর আসতে লাগল| তখন দিদির বয়স ১৬| দিদিকে কলকাতায় কোন আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারলে কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকা যায়, এই সব চিন্তা বাবা মার মনে| আমার বয়স ১৪, কিছুটা বুঝতে শিখেছি| এরই মধ্যে একদিন, আমাদের বাড়ির দুটো বাড়ি পরে একটা বাড়িতে মাঝরাতে কে বা কারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে,- হিন্দুর বাড়ি, ছাত বা দেয়াল পাকা নয়| বাড়িতে থাকতেন মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী| ভদ্রলোক অসুস্হ ছিলেন| সবাই দৌড়ে গিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার আগেই ওরা দুজন আগুনে বেশ খানিকটা পুড়লেন| চার পাঁচ দিন চুপচাপ কাটার পর আবার একদিন মাঝরাতে কে বা কারা পাশের বাড়িতে আগুন লাগালো| বাড়িগুলো পাকা বাড়ি নয়, দরমার বেড়া, খড়ের চাল,-এমন বাড়িতেই আগুন দিচ্ছে| আমরা তা ও থেকে গেছি| আশা করছি, শিঘ্রি শান্তি ফিরে আসবে| মার্চ মাস ১৯৫০ এলো| বাবা মার গুরুদেব মাতাজী বাবাকে একটা পোষ্টকার্ডে লিখলেন, “সবাই এপারে চলে আসছে, তোমরা কি এখনও আসবে না?” সেই রাত বাবা সারা রাত ভাবলেন, তারপর স্হির করলেন আমরা কলকাতায় যাব, যা থাকে কপালে! কোথায় উঠব? আত্মীয় স্বজন অনেক আছে, কিন্তু আটজনের একটি পরিবার দেখলে সবাই আঁতকে উঠবেন| কিন্তু সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল| অনেক কিছু কপালে লেখা ছিল, যা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি| দাদাকে চিঠি লেখা হল| স্হির হল আমরা ২৩শে মার্চ, ১৯৫০ রওনা হব| জানা গেল, সেজদার এক বন্ধুর পরিবার ও ঐদিন রওনা হবেন| সেজদার বন্ধুর(নাম ভুলে গেছি)বাবা Central Bank এর ম্যানেজার ছিলেন| তিনি সব ব্যবস্হা করলেন| পূর্বপাকিস্তান আনসার বাহিনীর দুজনকে ৫০০ টাকা করে দিয়ে আমাদের সঙ্গে সীমান্ত পর্যন্ত পাহারাদার রূপে যাবার জন্য রাজি করালেন| ২২শে মার্চ, আমরা সবাই সেজদার বন্ধুর বাড়ি(মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের কাছেই বাড়ি) রাতটা থেকে গেলাম| সমস্ত জিনিসপত্র ফেলে একটা ট্রাঙ্কে যা আঁটে তাই নিলাম| আর একটা বেডিং(বোধ হয় দুটো তোষক, বালিস সতরঞ্চি দিয়ে বেঁধে) নিয়ে যাচ্ছি সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা সহরে, সহায় সম্বলহীন অবস্হায়, নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়লাম| বয়স কম ছিল, তাই আমার বিশেষ উদ্বেগ হয় নি| বাবা মার চোখে মুখে উদ্বেগের ছায়া| কি হবে, ভালভাবে ওপারে পৌঁছাব তো? কোথায় উঠব?
২৩শে মার্চ সকালে দাঁতন দিয়ে দাঁত মেজে, সেজদার বন্ধুর বাড়িতে(কি সেন যেন, নাম ভুলে গেছি) গরম মুসুরির ডাল আলুভাজা দিয়ে ভাত খেলাম| পথে আবার কবে কখন খাবার পাওয়া যাবে জানা নেই| চিন্তায় চিন্তায় খুব একটা ক্ষিদে ও পায় নি| সবাই মিলে ময়মনসিংহ রেল স্টেশনে পৌঁছলাম সকাল দশটা নাগাদ| ১১টায় ট্রেন, জগন্নাথগঞ্জ যাবে| আমাদের থার্ড ক্লাসের টিকিট| লোকে লোকারণ্য| আনসার বাহিনীর গাইড, যারা আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে, ফার্স্টক্লাসে উঠতে বলল| ফার্স্টক্লাসেও তিলার্ধ জায়গা নেই| জানলা দিয়ে আমাদের মত ছোটদের ঢুকিয়ে দেওয়া হল| ময়মনসিংহ স্টেশন থেকে সম্ভবতঃ মাইল ৬০/৭০ দূরে জগন্নাথগঞ্জ স্টেশন, মেঘনা নদীর পাড়ে| ঘন্টা ছয়েকের রাস্তা| বিকেল পাঁচটা নাগাদ, অক্ষত দেহে আমরা জগন্নাথগঞ্জে পৌঁছলাম| সেখান থেকে নৌকা করে সিরাজগঞ্জ ঘাটে যেতে হবে, মাইল কুড়ি দূরে| সাধারণত নৌকাগুলো ২৫/৩০ টাকা করে নেয়| কিন্তু এত লোক এসে গেছে, নৌকো নেই| ঠিক হল, ৫০০ টাকা কোরে দেওয়া হবে| আমাদের দলের জন্য দুটো নৌকো লাগল| জগন্নাথগঞ্জ স্টেশন থেকে ঘাট মাইল দুয়েক হবে, বালির উপর দিয়ে হাঁটা দিলাম| বেডিং ও ট্রাঙ্কের জন্য কুলি নেওয়া হল| মেঘনা নদী অতি প্রশস্ত, এপার থেকে ওপার দেখা যায় না| ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে| নৌকোতে আলোর ব্যবস্হা বলতে ছিল একটা লন্ঠন আর কেরসিনের কুপি| ঘন্টা ২/৩ পরে পৌঁছলাম সিরাজগঞ্জ ঘাট| সেখান থেকে রাত্রে আবার ট্রেনে উঠলাম| এই ট্রেনে তুলনায় ভিড় একটু কম ছিল| এই ট্রেনে আমরা যাব ঈশ্বরদি স্টেশন পর্যন্ত| পৌঁছলাম পরের দিন সকালে| এখান থেকে ট্রেন বদলে যে ট্রেন ধরলাম সেটি বিকেল নাগাদ দর্শনা-গেদে সীমান্তে পৌঁছে দিল| সেখানে নেমে হাঁটা পথে ২/৩ মাইল গিয়ে সীমান্ত অতিক্রম কোরে পশ্চিমবঙ্গে গেদে এসে পৌঁছলাম বিকেল বিকেল, ২৪শে মার্চ ১৯৫০ সাল|
নিরাপদে সুস্হ শরীরে এবং সবাই সশরীরে পূর্বপাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম কোরে ভারতে পৌঁছতে পেরে আমরা সবাই উল্লসিত হলাম ও ভগবানকে ধন্যবাদ দিলাম| আগের দিন সকালে, ময়মনসিংহ থেকে রওনা হবার সময় সেই যে ভাত খেয়ে বেরিয়েছিলাম তারপরে জল ছাড়া কিছু পেটে পড়েনি| ঈশ্বরদি স্টেশনে ট্রেন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল| সেই সময় দুপয়সায় একটা বিস্কুট কিনে খাই| আর খাই টিউবওয়েল থেকে জল| খাবার চিন্তা ও মাথায় ছিল না|
সীমান্ত পার হবার পর অনেক ভলান্টিয়ারের দেখা পেলাম| তারা আমাদের সমাদর কোরে চিড় গুড় খেতে দিল| একটা খোলা মাঠে অনেকক্ষণ বসলাম, ঘুরলাম বেড়ালাম, ভারতের হাওয়া নিশ্বাস নিলাম প্রাণভরে| অনেকক্ষণ পরে গেদে/নদীয়া স্টেশনে ট্রেন এল| শিয়ালদহ পৌঁছলাম মধ্যরাত্রে| সেখানে, আমাদের মত উদ্বাস্তুদের জন্য লঙ্গরখানা খুলেছে কোন স্বেচ্ছাসেবি সংস্হা, বোধহয় রামকৃষ্ণ মিশন| শিয়ালদহ মেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আরও অন্যদের সঙ্গে আমরা সবাই সারি সারি বসে গেলাম| গরম গরম মুগের ডাল আর ভাত খেলাম, রাত ১টা নাগাদ| অমৃত খাচ্ছি মনে হল| মেন স্টেশনের পাশেই একটা গলিতে দেখলাম রাস্তায় সারি সারি অনেকে শুয়ে আছে, হয়ত আমাদেরই মত উদ্বাস্তু| আমরাও সতরঞ্চি পেতে, কালক্ষেপ না কোরে রাস্তায় খোলা আকাশের নীচে শুয়ে পড়লাম, তিন জনে একটা বালিস ভাগ কোরে মাথায় দিলাম| বালিস পাওয়া গেছে, এই ভাগ্য| মা বা দিদির হয়ত বালিস জোটে নি| খোয়ার রাস্তা, বেশ পিঠে লাগছিল, তাও যেন স্বর্গ মনে হচ্ছিল| সন্ধ্যা হলেই মিছিল কোরে “আল্লাহো আকবর” ধ্বনি দিতে দিতে মুসলমানরা বাড়ি ঘিরে ধরবে না, ছুরি মারবে না বা তরোয়াল দিয়ে কাটতে আসবে না, সেটাই তখন সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি| মাঝরাতে কে বা কারা পাশের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেবে না, এটা একটা বড় শান্তি ও স্বস্তি| আবোল তাবোল ভাবনা মাথায় এল, কি অপরাধে আমাদের এমন শাস্তি হল, হিন্দু হওয়া কি অপরাধ, যারা ক্ষমতার লোভে ভারত ভাগ করলেন তারা কি অপরাধী নন, ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না|
পরের দিন ২৫শে মার্চ ১৯৫০, সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই উঠে পড়লাম, শিয়ালদহ চত্বর ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম| আগে ময়মনসিংহের বাইরে কোথাও যাই নি, তাই যা দেখছি সব কিছুই নতুন মনে হচ্ছে| একটু বেলার দিকে দাদা এসে আমাদের খুঁজে বের করলেন| দাদার সঙ্গে ছিলেন আমার ছোট মামা, দিলীপচাঁদ গুপ্ত, মার তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট| কলকাতায় পুলিসে চাকরি করে| একটু বেলার দিকে ওরা দাদার মেস বাড়িতে আমাদের নিয়ে এলেন| সেখানে নীচ তলায় একটা ছোট ঘর পাওয়া গেছে আমাদের জন্য, বোধ হয় ১০ফুটx ৯ফুট |
সেখানে আমরা উঠলাম|
সেই রাতটা ঐ ঘরে গাদাগাদি করে শুয়ে আমরা ঘুমোলাম| অঘোরে ঘুমালাম| মিছিল, “আল্লাহো আকবর” ধ্বনি নেই, প্রাণের ভয় নেই| এই আমাদের কলকাতা বাসের কাহিনীর সূত্রপাত| জীবন সংগ্রাম কাকে বলে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এইভাবে সুরু হল|
ভোরে ঘুম ভাঙ্গল জল দিয়ে রাস্তা ধোয়ার শব্দে| তখনকার দিনে কলকাতায় কর্পোরেশনের লোকেরা গঙ্গাজলের হাইড্র্যান্ট থেকে জল নিয়ে, দমকলের লোকদের মত লম্বা লম্বা পাইপের সাহায্যে রাস্তা ধুত| রাস্তা ধোয়ার কাজ শেষ হবার কিছুক্ষণ পরে সুরু হল ফেরিওয়ালাদের নানারকম আওয়াজ| একটা অদ্ভুত আওয়াজ বা চিৎকার এখনও মনে আছে| আমি যা শুনতে পেলাম তা হল, “টিকুর জলমে জলমেকে সলেস”| এক ফেরিওয়ালা মাথায় একটা বাক্স নিয়ে এমন অদ্ভুত চিৎকার করতে করতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম| লোকটা চন্দ্রপুলি ক্ষীরের সন্দেশ বিক্রি করছে, পরে জানতে পেরেছি| আরও কত যে ফেরিওয়ালা রাস্তা দিয়ে চিৎকার করতে করতে গেল, তাদের আওয়াজ শুনতে ভারি মজা লাগল| এই ঘরে দুএকদিন থাকার পর আস্তানার পরিবর্তন হল।
মা বাবার গুরুদেব মাতাজী যাদবপুরে এক শিষ্যের বাড়ি থাকতেন| জায়গাটা বিজয়গড় কলোনি| যত দিন অন্য ব্যবস্হা না হচ্ছে এবং বাবা কোন চাকরি না পাচ্ছেন ততদিন ওঁর বাড়িতে(বা আশ্রমে) আমাদের থাকতে দিলেন| বাঁশের বেড়া টিনের ছাদ| আমার কোন কাজ নেই, লেখাপড়ার বালাই নেই| সম্পূর্ণ ভবঘুরের মত তিন মাস,-এপ্রিল, মে, জুন এই তিন মাস কেটেছে|
প্রথম মাসটা ছিলাম মাতাজীর আশ্রমে বিজয়গড় কলোনিতে। বাবা সারাদিন চাকরির চেষ্টা কোরে চলেছেন, লোকজনের সঙ্গে দেখা করছেন, দরখাস্ত করছেন,-কিন্তু চাকরি নেই| তখন আমাদের সংসার কি কোরে চলত তা আমি ভেবে পেতাম না| দাদাই একমাত্র উপার্জনকারি, মাসে বোধ হয় দেড়শো টাকা মাইনে, থাকেন মেসে| আর সরকার থেকে রিফিউজি সাহায্য(ডোল) দেওয়া হত, সপ্তাহে জনপ্রতি 5টাকা কোরে, মোট 40টাকা সপ্তাহে| এর থেকে এতগুলো লোকের খাওয়া ও অন্যান্য খরচ কি কোরে চলত ভেবে পাই না| মাতাজীর আশ্রমে যতদিন ছিলাম থাকা খাওয়ার জন্য ওঁকে কিছু দিতে হয় নি| বাবা দিবারাত্র পরিশ্রম কোরে চাকরি খুজছেন, চাকরি নেই|
বিজয়গড় বাজারের উল্টো দিকে তখন একটা বড় পুকুর ছিল| সেখানে ঘন্টা খানেক, ঘন্টা দুয়েক রোজই সাঁতার কাটতাম যদিও পুকুরের জল বিশেষ পরিষ্কার ছিল না| বিশেষ কারু সঙ্গেও চেনাশোনা হয় নি| মাতাজীর আশ্রমে আমাদের দীর্ঘদিন থাকা ওঁর কোন কোন শিষ্য, যাদের অর্থসাহায্যে আশ্রম চলত, ভাল চোখে দেখলেন না।
পরের দুমাস ঢাকুরিয়া স্টেশন রোডের দুই কামরার বাড়িতে,- ইলেক্ট্রিসিটি ছিল, খাটা পায়খানা, জলের ব্যবস্হা বলতে পাশের পানাপুকুরের জল, রান্নার বা খাবার জল ১০০গজ দূরের রাস্তার কল থেকে নিয়ে আসতে হোত| তার পরের মাসে, সম্ভবত জুনের শেষে অবস্হার একটু উন্নতি হল| ঢাকুরিয়া স্টেশন সংলগ্ন একটা ছোট দোতলা বাড়ির নীচ তলার দুটো ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম, স্যানিটারি পায়খানা, কলের জলওয়ালা ফ্লাট ভাড়া নিলাম| পরের মাসে বাবা মতিঝিল কলেজে অধ্যাপনার কাজ পাবার পর একটু একটু কোরে সব ভালর দিকে যেতে লাগল| একটা সম্পূর্ণ নতুন সংসার স্হাপন, “চূনের খুঁটি, নুনের বাটি” থেকে সুরু করে সব কিছু কিনতে হচ্ছে, অফুরন্ত টাকা থাকলে চিন্তা ছিল না| খুবই অর্থকৃচ্ছতার মধ্যে দিন কাটছে|
অবশেষে, মে মাস নাগাদ ঢাকুরিয়া স্টেশন রোডের পাশের একটা গলিতে আমরা একটা পুরনো বাড়ি ভাড়া নিই| দুটো ঘর, একটা বারান্দা, রান্নাঘর, একটু ছাড়া ছাড়া| অ্যাসবেস্টাসের ছাদ| পাশেই পানা পুকুর, সেখানে বাসনপত্র ধোয়া, জামকাপড় ধোয়া চলত| ১০০ গজ দূরের রাস্তার কল থেকে খাবার ও রান্নার জল আনতে হত| আর ছিল খাটা পায়খানা| মাসিক ভাড়া 22 টাকা| এই টাকা দেবার মত আর্থিক সঙ্গতি ও আমাদের ছিল না| সৌভাগ্যক্রমে, এই সময় মেজদা India Fan Co. তে Machine operator/Latheman এর চাকরি পেয়ে যায়| মায়না মাসে ৮০টাকা| বাবা চাকরির সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কোথাও চাকরি নেই| বাবার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অধ্যাপকরূপে অভিজ্ঞতা খুবই ভাল ছিল| অনেকের কাছে শুনেছি পড়াতেন ও খুব ভাল| মেজদার ডিপ্লোমা ছিল মেকানিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং এ|চাকরি খুঁজে চলেছেন| ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের অধ্যাপনার চাকরিটি গেল, না জানিয়ে অনুপস্হিত থাকার জন্য| ওখান থেকে কিছু অল্প পরিমান টাকা পাওয়া যায়| সেজদা, ওর বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এই সময় ময়মনসিংহে যায় ও আমাদের ভাড়া বাড়ির আসবাব পত্র বিক্রি ও অন্যান্য জিনিসপত্র বিলিয়ে দিয়ে আসে| সেখান থেকে অল্প কিছু বইপত্র, শয্যাদ্রব্য, বাসনপত্র নিয়ে আসে| এইইভাবে আমাদের দিন চলতে লাগল|
কলকাতায় আসার দু তিন দিন পরে, একদিন খালি পায়ে, আমি বাবার সঙ্গে দেশপ্রিয় পার্ক রোডে আমার ছোড়দাদু অবনীপ্রসাদ নিয়োগীর বাড়ি যাই| আমার ঠাকুর্দা রামপ্রসাদ নিয়োগীর পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ইনি কনিষ্ঠ| বাড়িটি তিন তলা| বাড়িতে ঢুকে লক্ষ্য করলাম, আমার পায়ে প্রচুর ধুলো, একটু লজ্জা করতে লাগল| ময়মনসিংহে আমরা অবশ্য খালি পায়েই চলাফেরা করতাম, ইস্কুলে যেতাম| দেখলাম, কলকাতায় বড় কেউ খালি পায়ে নেই| দাদুর বয়স হয়েছে, সম্ভবতঃ আশির কাছাকাছি| তাঁর তিন ছেলে, বড় ব্রজেন্দ্রপ্রসাদ (হাবলি কাকা), মেজ পচু কাকা(Dr. B.P. Niyogi) আর ছোট ছেলে গগু (সুধীন্দ্রপ্রসাদ) ও নাতি নাতনিরা ঐ বাড়িতে থাকতেন| হাবলি কাকার দুই মেয়ে রুন্টু, ঝুন্টু যমজ, আমার এক ক্লাস উপরে পড়ত, সবে ম্যাট্রিুকুলেশন পরীক্ষা দিয়েছে দুজন| ওরা অনেকে মিলে একদিন আমাদের ঢাকুরিয়ার বাড়িতে এলেন| কাকিমারা ফিরে যাবার সময় দিদিকে ওদের সঙ্গে ওদের বাড়ি নিয়ে যান| দিদি ওখানে মাসখানেক ছিল|
বিজয়গড়ের মাতাজী আশ্রমে থাকার সময় থেকেই আমি সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াতাম| মাঝে একবার পুকুরে স্নান করতে যেতাম| লেখাপড়ার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই, ভবিষ্যতে যে কখনও আবার পড়াশুনা করব সে সম্ভাবনা ছিল না| ঢাকুরিয়া স্টেশন রোডের বাড়িতে যাবার পর সেজদা একদিন বলল, কিরে দুলাল(আমার ডাক নাম), সারাদিন এমন ভ্যাগাবন্ডের মত টো টো করে ঘুরে বেড়ালেই চলবে? লেখাপড়া করতে হবে না? আমি হেসে বললাম, আমার তো বইপত্র খাতা কাগজ কলম পেন্সিল কিছুই নেই পড়াশুনা করব কি কোরে? সেজদা বলল, চারপাশে যে স্কুল গুলো আছে, যেমন রামচন্দ্র হাই স্কুল, তাদের হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা কোরে বল যে তুই ময়মনসিংহ মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে ক্লাস টেনে পড়তিস, transfer certificate নেই, টাকা পয়সা কিছু দিতে পারবি না, উদ্বাস্তু বলে তোকে যেন ভর্তি কোরে নেয়| কথামত রামচন্দ্র স্কুলের হেডমাস্টার মশায়ের সঙ্গে দেখা করলাম| ঘরে আরও ২/৩ জন মাস্টারমশাই বসে ছিলেন| তিনি বললেন, অন্তত দুমাসের মায়না দিতে হবে, আর আমরা একটা পরীক্ষা নিয়ে দেখব, পাস করলে ভর্তি করে নেব| মায়না দেবার মত আর্থিক সামর্থ আমার নেই, তাই ফিরে আসতে হল| এরপর একদিন, রাস্তার কলে যেখানে রান্নার ও খাবার জল আনতে যাই, কমল বলে একটি ছেলে আমার সঙ্গে আলাপ করল| ও Southend Park এ Lake View School এ ক্লাস টেনে পড়ে| শুনলাম ঐ স্কুলে লেখাপড়া বড় একটা হয় না, খুব কম সংখ্যক ছাত্রই ম্যাট্রিক পাস করে, অন্য স্কুলের ফেল করা ছাত্ররা ওখানে পড়ে| ঐ স্কুলের তৎকালিন হেডমাস্টার শ্রী M.L. Das মশায়ের সঙ্গে একদিন দেখা করলাম, বোধ হয় তখন জুন মাস| মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের ছাত্র শুনে উনি খুব খুসি হলেন| পরে শুনেছি, উনি নিজেও ঐ স্কুলের ছাত্র ছিলেন| উনি বল্লেন, ঠিক আছে, টাকা দিতে হবে না| তোমাকে ভর্তি কোরে নিচ্ছি, কাল থেকে ক্লাস করো, একটা পরীক্ষা দিতে হবে, অঙ্ক, ইংরেজি আর সংস্কৃত বিষয়ে|
এইভাবে আমার ভবঘুরে জীবনের অবসান ঘটল, লেকভিউ স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র হলাম| সেজদার কাছ থেকে চার আনা নিয়ে একটা ৩২পাতার
খাতা আর একটা পেন্সিল কিনে বাড়ি থেকে হেঁটে স্কুলে গেলাম| বইপত্র কিছুই নেই| ডিসেম্বরে Test পরীক্ষা হবে| মৃত্যুঞ্জয় স্কুল ছিল ঢাকা বোর্ডের অধীনে| ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি বিষয় অনেকটাই আলাদা| যেমন, ইতিহাসে ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে ইসলামিক ইতিহাস, ভূগোলে পাক-ভারত ও ভূমন্ডল ইত্যাদি পড়তে হত| সে জায়গায় এখানে ব্রিটিশ হিস্ট্রি ইত্যাদি আর ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত selection ও rapid reading বইগুলো সব আলাদা, নতুন কোরে পড়তে হবে| মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে, বলতে দ্বিধা নেই, আমি ভাল ছাত্র ছিলাম| ক্লাস এইটে চারটে সেকসন মিলিয়ে ফার্স্ট হই| আর এখানে টেস্টের আগে, ৫/৬মাসের মধ্যে ১৩খানা সম্পূর্ণ নতুন বই পড়ে, দুবছরের সিলেবাস শেষ করে, পরীক্ষা দিতে হবে| এই সময় ভগবানের আশীর্বাদের মত আমার খুড়তুতো দিদি, রুন্টি-ঝুন্টিদিরা ম্যাট্রিক পাস করল| ফল বের হবার পর, ওদের সব বইপত্র দিয়ে আমায় সাহায্য করে| আমার যে কত বড় আনন্দ হল, তা বলে শেষ করা যায় না| বাড়িতে পড়ার জায়গা নেই, কোনক্রমে তারই মধ্যে বারান্দায় পড়া শুরু করলাম জোর কদমে জুলাই মাস থেকে| এই সময় স্কুলে আমার বন্ধু হয় কমল কৃষ্ণ দে, সুনীতি রায়চৌধুরি আর সুনীল ব্যানার্জী| সুনীতি আমারই মত উদ্বাস্তু, চাঁটগা থেকে এসেছে আর সুনীল পড়ত কুমিল্লার বিখ্যাত স্কুল ঈশ্বর পাঠশালায়| কমল থাকত ঢাকুরিয়ায়| আমায় যে কতভাবে সাহায্য করেছে তা বলে শেষ করা যায় না| আমার অবিচ্ছেদ্য বন্ধু ছিল কমল|
এই সময় জুলাই/অগাস্ট মাসে বাবা দমদম মতিঝিল কলেজে অধ্যাপনার কাজ পেলেন| আমাদের আর্থিক সঙ্গতি একটু বাড়ল| বাবা রোজ সকালে ট্রেনে কোরে শিয়ালদহ হয়ে দমদম স্টেশনে যেতেন| সেখান থেকে হেঁটে কলেজে পড়াতে যেতেন| এইভাবে, দিনের পর দিন চলতে লাগল| খাওয়া দাওয়ার খুব অসুবিধে হত বাবার| আমরা বাড়ি বদলে, ঢাকুরিয়া স্টেশনের পাশে বাবুবাগানে একটা দুই কামরার বাড়িতে উঠে গেলাম| আগের বাড়ির তুলনায় এটি অনেক ভাল| ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর, বিকেলে ও সন্ধ্যায় ঢাকুরিয়া স্টেশনের ওভারব্রিজে বসে আমরা বন্ধুরা সময় পেলে গল্প করতাম| মাঝে মাঝে নতুন বন্ধুও এসে জুটত| তাদের কাছেই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের নাম প্রথম শুনি| আর জানতে পারি সুকান্ত নাকি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অনেক ভাল কবিতা লিখে গেছে, মারা গেছে মাত্র ১৯বছর বয়সে|
এইভাবে আমাদের নতুন জীবন একটা স্হিতির দিকে এগুতে লাগল, যদিও বহু জিনিসের অভাব মাঝে মাঝে পীড়াদায়ক বোধ হতে লাগল| যেমন, অঙ্কের একটা Test paper solve করতে কতক্ষণ লাগে দেখব যে, বাড়িতে কোন ঘড়ি নেই! কমলদের একটা ছোট টাইমপিস ছিল| ও বলল যে তুই আমাদের বাড়ি এসে পরীক্ষা দে, অর্থাৎ test-paper সমাধান কর, আমিও করব তোর সঙ্গে| সময় পরীক্ষা কোরে দেখলাম, আমার লেগেছে দেড় ঘন্টা| পরে দেখেছি তিন ঘন্টার কোন অঙ্কের প্রশ্ন সমাধানে আমার কখনই দেড়-ঘন্টার বেশি লাগে নি|
এটা ছিল আমার ও আমাদের পরিবারের জীবনে একটা সন্ধিক্ষণ| জ্ঞান হবার পর থেকেই ছিলাম ময়মনসিংহে- পূর্বপাকিস্তানে, অধুনা বাংলাদেশে| কলকাতা তথা ভারতে প্রথম পা রাখি ২৪শে মার্চ, ১৯৫০, আমার চৌদ্দ বছর বয়সে| নিদারূণ অভিজ্ঞতা| প্রথম ভাত খেলাম লঙ্গরখানায়, প্রথম রাত কাটালাম রাস্তায় খোলা আকাশের নীচে শুয়ে, পরের দিন সারা সকাল কাটল সম্পূর্ণ অপরিচিত শিয়ালদহ স্টেশনের চারপাশের রাস্তায়| আমাদের মত অগুনতি রিফিউজি বা উদ্বাস্তু আমাদের চারপাশে| কেউ বা ওখানেই পাকাপাকি ঘরবাড়ি বানিয়ে নিয়েছে, বেশ কিছুদিন ধরে রয়েছ, অন্য কোন জায়গা নেই যাবার| রাস্তাই এদের ঠিকানা|
বাবা মতিঝিল কলেজে অধ্যাপনার কাজ পাবার পর একটু একটু কোরে সব ভালর দিকে যেতে লাগল| একটা সম্পূর্ণ নতুন সংসার স্হাপন, “চূনের খুঁটি, নুনের বাটি” থেকে সুরু করে সব কিছু কিনতে হচ্ছে, অফুরন্ত টাকা থাকলে চিন্তা ছিল না| খুবই অর্থকৃচ্ছতার মধ্যে দিন কাটছে| এইভাবে একদিন লেকভিউ হাইস্কুলের ক্লাস টেনে ভর্তি হলাম,-সেকথা আগেই বলেছি| রুন্টু ঝুন্টুদিদের কাছ থেকে অনেক বই খাতা পেলাম, ওরা ম্যাট্রিক পাস করে যাবার পর,-সম্ভবত জুলাই মাসের গোড়ার দিকের কথা| আমার ভবঘুরে জীবনের ইতি এল এভাবে| একটা দিশা দেখতে পেলাম,-আবার পড়াশুনা শুরু করলাম, এসম্বন্ধে আগে বলেছি|
লেকভিউ স্কুলের ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বেশ ভাল হল| যেকয়জন পরীক্ষা দিয়েছিল তাদের মধ্যে ২/৩জন বাদে সবাই পাস করেছে, তিন জন সেকেণ্ড ডিভিসন পেয়েছে, যদিও ফার্স্ট ডিভিসন কেউ পায় নি| এমন ভাল ফলের জন্য স্কুল একদিন ছুটি ঘোষণা করে| তাছাড়া ছাত্ররা দুদিন হাফ ছুটির ব্যবস্হা করে ফেলে| আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল, কি স্কুল! মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের সঙ্গে অজান্তে তুলনা এসে পড়ে| ভয় হয়, এখান থেকে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়াই তো শক্ত হবে দেখছি! ময়মনসিংহে থাকতে নাইন/টেন ক্লাসে খুব মন দিয়ে পড়াশুনা করতাম যাতে সেজদার থেকেও ভাল ফল করতে পারি| ওখানে থাকলে এবং শান্তিতে থাকতে পারলে হয়ত তাই হোত| এখন ১৩খানা সম্পূর্ণ নতুন বই, দুবছরের পাঠক্রম শেষ করতে হবে ৬মাসে, যেন পর্বতপ্রমাণ বোঝা মাথায় চাপল| আমি অবশ্য বিন্দুমাত্র না দমে আপনমনে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে লাগলাম| ডিসেম্বর মাসে টেস্ট হল| ফল ভালই হল, বোধ হয় ক্লাসে ফার্স্ট|
১৯৫১ সালের গোড়ার দিকে ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্না হলেন| এমন একটা ঘটনা ঘটল, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না| বাবা হঠাৎ বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতে, কলেজ অফ ইণ্ডোলজিতে Asst. Prof. পদে appointment letter পেলেন| আশ্চর্য ব্যাপার! বাবা বললেন আমি তো ওখানে apply করিনি, চাকরি পেলাম কি করে? দাদার কাছে জানা গেল, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে দাদা সাদা কাগজে ওখানে apply করেন| ওদের application form এ 5/-টাকার Postal Order সহ apply করার কথা| দাদা লেখেন, displaced person, পয়সা নেই, পোস্টাল অর্ডার দিতে পারছি না| কোন Certificate নেই, academic qualification, অভিজ্ঞতা ইত্যাদির কোন প্রমাণ দাখিল করতে পারেন নি| আর application এর নীচে দাদাই, বাবাকে না জানিয়ে, বাবার নাম সই কোরে দেন| যেটুকু ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তা হল, ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে তখন তিন বছরের B.A.(Hons) চালু হয়েছে, তৃতীয় বছরটা M.A.(Previous) এর তুল্য| বাবা সেখানে Vedic Philology পড়াতেন, যে অভিজ্ঞতা চাকরির বিজ্ঞাপনে চাওয়া হয়েছিল| ওরা তাই দেখেই সম্ভবত বাবাকে সরাসরি Assistant Professor এর Appointment Letter পাঠিয়ে দেয়| সেজদাকে নিয়ে বাবা বেনারস যান, বোধ হয় মার্চ মাসে, কাজে যোগদান করেন| “খুদা যব দেতা হায়, ছপ্পর ফোড়কে দেতা হায়”, – এটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ| “বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা হয় না”, এমন ঘটনা আমার জীবনে আরও ঘটেছে, উপযুক্ত জায়গায়, সুযোগমত তা বলার ইচ্ছে থাকল|
বেনারস গিয়ে বাবারা সোনারপুরা অঞ্চলের আউধগর্বীতে একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকা শুরু করলেন| মাস দুতিন পরে আমরা সবাই যাই| হরিশ্চন্দ্র ঘাটের রাস্তায়, অন্য একটা তিন তলা পাকা বাড়ির দোতলা ভাড়া নিই| চারটে ঘর, রাস্তার দিকে দুটো ঘর আর পিছনের দিকে দুটো, ঠাকুরঘর, রান্নাঘর, মাঝে সিড়ি, বাথরুম, কলের জল আছে কিন্তু বিদ্যুত নেই| টাকা দিয়ে ওয়্যারিং করিয়ে বিদ্যুৎ আনতে অনেক খরচ| এই বাড়ির ভাড়া মাসে ২২টাকা | জুন মাস, প্রবল লু চলছে| এসম্বন্ধে পরে বলছি|
বাল্যস্মৃতিঃ বেনারসের দিনগুলি
বেনারসে প্রবল গরম, লু চলছে| এই অবস্হায় আমরা প্রথম বেনারস গেলাম, ১৯৫১ সালের জুন মাসে| উঠলাম এমন বাড়িতে যেখানে বিদ্যুৎ নেই| তাও বেনারসের দিনগুলি আমাদের ভাল কেটেছে|
বাড়িটার পেছনের ঘর দুটো অন্ধকার, তুলনায় ঠাণ্ডা| দরজা জানালা সব আলকাতরার রঙ করা, যাতে ঘর ঠাণ্ডা থাকে| গ্রীস্মকালে যখন লু চলত, দুপুরে আমরা অন্ধকার ঘরে ঘুমোতাম, মার হাতে থাকত হাতপাখা| রাত্রে সবাই ছাতে শুতাম| সূর্যাস্তের পর থেকে বালতি বালতি জল ছাতে ঢালতাম| তার উপর দিয়ে লু চললে ছাত খুব ঠাণ্ডা হয়ে যেত| দিনের বেলা, সকাল ৯টার পর বাড়ির বাইরে কোথাও যেতে হলে প্রচুর জল খেয়ে বের হতে হত, ছাতা থাকলে ভাল| পকেটে পেঁয়াজ নিয়ে বের হলে নাকি heat-stroke হয় না| সূর্যাস্তের পর বড় বড় মাটির জালা ভর্তি করে ফেরিওয়ালারা রাস্তা দিয়ে পোড়া আমের সরবত চিৎকার করে বিক্রি করতে করতে যেত| আমাদের বাড়িটার রাস্তার দিকে সরু চার ফুট চওড়া একটা বারাণ্ডা ছিল| তার লোহার রেলিঙে লন্ঠন ঝুলিয়ে সতরঞ্চি পেতে আমি সন্ধ্যাবেলা পড়তে বসতাম| কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর নীচের রাস্তা দিয়ে, “রামনাম সৎ হ্যায়” ধ্বনি দিতে দিতে মিছিল করে শবযাত্রা যেত| আমার অবশ্য এতে কোন ভ্রুক্ষেপ হোত না| মাঝে মাঝে আমার বন্ধু পীযূষ সাইকেল করে এসে, রাস্তা থেকে প্রদীপ প্রদীপ করে ডাকত| ওর বেশি পড়তে ভাল লাগত না| বয়স কম ছিল বলেই হয়ত গরমে কষ্টবোধ ছিল না| এখন, গরমে কলকাতায় রোজই A/C চালাই, তাও মনে হয় অসহ্য গরম| চাতক পাখির মত একটু বৃষ্টির জন্য হাপিত্যেস চলছে সর্বত্র| বেনারসের দিনগুলো আমার কিন্তু ভালই কেটেছে|
বেনারসে দুবছর, ১৯৫১-৫৩, আমরা একটা স্হিতি লাভ করি| ১৯৯৫১ সালের জুনের শেষ দিকে, বেনারসের আ্যঙ্গলো-বেঙ্গলি কলেজে I.Sc. first year class এ বাবা আমাকে ভর্তি করে দেন| ঐ কলেজের Vice-principal বাবার বিশেষ পরিচিত, তাই ম্যাট্রিকের ফল বের হবার আগেই আমাকে provisionally ভর্তি করে নেন| কলেজটা আমার খুব ভাল লাগল| বিশেষ করে, কয়েকজন বন্ধু পেলাম,- পীযূষ, রঞ্জু(অমিতাভ চক্রবর্তী), তরুন আরও অনেকে| রঞ্জুর কিরকম যেন ভাই কেশব, পাশের বাড়ির নলিনী, আমাদের এক ক্লাস উঁচুতে পড়ত, এরা সব বন্ধু হল| রঞ্জুরা থাকত নারদ ঘাটের পাশে| কেশব নলিনীরাও পাশেই থাকত| বন্ধুদের সঙ্গে সময়টা বেশ ভাল কাটত| আর ছিল সমরেন,-বাবার সঙ্গে থাকত, মা মারা গেছেন আগে| এই বন্ধুদের জন্য খুব আনন্দে কেটেছে| এই বন্ধুরা পড়াশুনায় বিশেষ ভাল ছিল না| ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করত, “কিরে, ম্যাট্রিক পাস করতে পারবি তো?” আমি খুব আশ্চর্য হয়ে বলতাম, পাস করব না কেন? জুলাই মাসের গোড়ার দিকে একদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকের ফল বের হল, বন্ধুরা বলল রেডিওতে বলেছে, খবরের কাগজেও পরের দিন লিখেছে| আমরা দাদার কাছ থেকে একটা টেলিগ্রাম আশা করছি| টেলিগ্রাম এল না, বন্ধুরা ধরে নিল ফেল করেছি| ওরা আমার রেজাল্ট সম্বন্ধে খোঁজ নেওয়া বন্ধ করে দিল| এমন সময় দাদার কাছ থেকে একটা পোস্টকার্ডে আমার ও দিদির result এল| আমি I, দিদি F. দিদি ঢাকা বোর্ডের সিলেবাসে special matriculation পরীক্ষা দিয়েছিল| পরীক্ষার প্রোগ্রাম Senate hall এর নোটিস বোর্ড থেকে টুকে আনতে দিদির ভুল হয় যে জন্য একটা বিষয়, হয়ত বাংলা 2nd paper বা ইতিহাস, কোন একটা বিষয়ে পরীক্ষা miss করে| দিদি পাস করতে পারবে না,- একটা বিষয় পরীক্ষা না দিয়ে পাস করা সম্ভব না এটা আমরা জানতাম | দিদি কান্নাকাটি করল| আমার বন্ধুরা সব আশ্চর্য হয়ে গেল, পাস করেছি First division এ তাও telegram নেই কেন!
Anglo Bengali college এ দুবছর খুব আনন্দে কেটেছে| অঙ্ক পড়াতেন পাঁচু বাবু, -খুব ভাল পড়াতেন, জর্দা পান খেতেন| কিন্তু সিলেবাসের খুব সামান্য অংশই শেষ করেছেন| তেরোখানা অঙ্কের বইয়ের মধ্যে ২/৩খানার বেশি পড়ান নি| বই যোগাড় করে, সম্পূর্ণ একক নিরলস চেষ্টায় বাকি বইগুলো পড়ি, শিখি , প্রশ্নমালা সমাধান করি| আমাদের Physics পড়াতেন Mr. Subramaniam. অত্যন্ত দ্রুত ইংরেজি বলতেন, খুব একটা বুঝতাম না, নিজেই পড়তাম|Chemistryর মাস্টার মশাই আর একজন দক্ষিণ ভারতীয়, Mr Rao. মোটামুটি বুঝতাম| ইতিমধ্যে একদিন আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার মার্ক-সিট দাদা পাঠিয়ে দিলেন| দুটো অঙ্কে লেটার, compulsory অঙ্কে 99/100. আমি নিজেও ভাবিনি এত বেশি নম্বর পব| 1951-53 এই দুই বছর বিদ্যুৎহীন বাড়িতে, বারান্দায় লন্ঠন ঝুলিয়ে আমার নিরলস সাধনা চলল| আমার চেহারা ছিল খুব রোগা, অপুষ্টির লক্ষণ| I.Sc.র ফল বেশ ভাল হল: অঙ্কে 92/100, chemistry 84/100, Physics 72/100, ইংরেজি 48/100, হিন্দি 52/100. হিন্দি নিয়ে খুব চিন্তা ছিল| বেনারস যাবার পর আমি হিন্দি শিখেছি- দেবনাগরি হরফে লেখার অভ্যাস ছিল না- নিয়মিত অভ্যাস করতে হয়েছে| I.Sc. র কলেজের test পরীক্ষায় হিন্দিতে 29/100 পাই| মাস্টারমশায় বললেন, ইচ্ছে করেই তোমায় পাস করাই নি| এখন যে ২/৩মাস ফাইনাল পরীক্ষার বাকী আছে, মন দিয়ে হিন্দি লেখ এবং পড়| এই উপদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি| Chemistry তে মনে রাখার ব্য্যাপার আছে| কোন কিছু বাদ না দিয়ে পুরো সিলেবাস পড়ি| মনে রাখার সুবিধের জন্য, যা পড়লাম খুব সংক্ষেপে summary আকারে লিখে ফেলি| এতে সুবিধে হল, summary দেখলেই property, reaction ইত্যাদি মনে পড়ে যায়| আমাদের বার chemistry প্রশ্ন খুব খারাপ হয়েছিল, একাধিক unimportant unexpected প্রশ্ন এসেছিল, কিন্তু আমার কোন অসুবিধে হয় নি,- ফলেই বোঝা যায়| আমার বন্ধুদের মধ্যে হিন্দিতে আমি highest পাই, রোজ নিয়মিত হিন্দি পড়া ও লেখার ফল|
I.Sc. পাস করার পর আমার ইচ্ছে হল সেজদার মত প্রেসিডেন্সিতে Statistics(Hons) নিয়ে পড়ব| তখনকার দিনে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলেজ| আমার I.Sc. result এর ভিত্তিতে, ইচ্ছে করলে আমি B.H.U.(Benares Hindu University) তে যে কোন ইন্জিনিয়ারিং বিষয়ে ভর্তি হতে পারতাম| কিন্তু আমার ইচ্ছে প্রেসিডেন্সিতে পড়ব| সেজদা জানাল admission হয়ে গেছে| আমি, সম্ভবত 8th July, 1953, কলকাতায় ভবানীপুরে দাদার বাসায় চলে এলাম| সেদিন দাদার বড় মেয়ে ঝুমুর অন্নপ্রাশন চলছিল| এসে সেজদার কাছে শুনলাম আমি Mathematics(Hons) এ admission পেয়েছি| Statistics ডিপার্টমেন্টের Head নাকি বলেছেন, Mathematics এ তো খুব ভাল নম্বর পেয়েছে, তাই Maths(Hons) পড়ুক| এইভাবে আমার জীবনের পরবর্তী অধ্যায় সুরু হল|
বাস্তুহারা ছাত্রদের কথা ভেবে সেবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বোর্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুযায়ী Special matriculation, special I.A, I.Sc.ইত্যাদি পরীক্ষা নেয়| সেজদা special I.Sc. পরীক্ষা দেয়| আর দিদি দেয় special matriculation. 1950 সালের পরীক্ষা পুজোর পর পর হল| I.Sc. র ফল বরোল 1951 র ফেব্রুয়ারি/মার্চ নাগাদ| সেজদার ফল খুব ভাল হয়েছে, যেমন প্রত্যাশিত ছিল| আশ্চর্য, বাংলায় লেটার পেয়েছে! অঙ্কে আর পদার্থবিদ্যা বা রসায়নের কোন একটাতে লেটার| পরবর্তী কালে Statistics(Hons) নিয়ে Presidency college এ ভর্তি হয়| Statistics(Hons) নিয়ে Presidency তে seat পাওয়া খুবই শক্ত ছিল কারন সিটের সংখ্যা ছিল মাত্র 15. ক্লাস সুরু 1951 সালের ৯ই জুলাই| এই সময় ওর পড়াশুনায় বেশ বিঘ্ন ঘটে| B.Sc.(Hons) এর Physics(pass) practical পরীক্ষায় external examiner এর সাথে সেজদা ঝগড়া করে| Examiner ওকে practical এ 0(শূন্য) দিয়ে দেন| পরে জানা যায়, ওই external examiner Dr. B.C.Guha, ছাত্রাবস্হায় বাবার বিশেষ বন্ধু ছিলেন| দেখা করতে গেলে, তিনি সেজদাকে বলেন, “ ওঁর মত দেবতুল্য লোকের তোমার মত অকালকুস্মাণ্ড ছেলে হল কি করে?” পরের বার সেজদা রসায়ন(pass) theoryতে ফেল করে| তার পরের বছর আমার সঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে First class (Hons) নিয়ে পাস করে| আমিও সেবছর (1955 সালে) অঙ্কে(Hons)নিয়ে Presidency college থেকে First class পেয়ে B.Sc. পাস করি| যুগান্তর পত্রিকায় “ভ্রাতৃদ্বয়ের কৃতিত্ব” শিরোনামে এই মর্মে খবর বের হল| তখনকার দিনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন বিষয়ে First class(Hons) বিশেষ কৃতিত্ব বলে বিবেচিত হত|
পরবর্তী কালের কথা
বাল্যকাল মানুষের জীবনে ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করে| আমার বাল্যকালের প্রধান ঘটনাগুলো লিখলাম| এদের মধ্যে ১৯৫০ সালের ২৩-২৪শে মার্চ উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতায় আসা আমাদের জীবনকে সমূলে উৎপাটিত করে, সম্পূর্ণ লণ্ডভণ্ড করে দেয়| এটা একটা আকস্মিক বিরাট বিপর্যয়| সৌভাগ্যক্রমে আমরা সেই বিপর্যয় অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিয়ে হলেও ভালভাবে অতিক্রম করেছি| পরবর্তী সময়ে, আমরা তিন ভাই, সেজদা, আমি ও মন্টু(দীপক) প্রসিডেন্সি কলেজে B.Sc.(Hons) পড়েছি এবং আমরা তিন জনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের First Class Honours পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি| সেজদা ও আমি 1955 এ যথাক্রমে Statistics ও Mathematics এ, আর মন্টু 1958 তে Mathematics এ| তখনকার দিনে, যে কোন বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে First Class Honours পেয়ে পাস করা বিরল কৃতিত্ব বিবেচিত হত| মন্টু পরে Radio Physics & Electronics এ C.U. থেকে B.Tech. ও M.Tech. পাস করে| সেজদা এক বছর Statistics এ M.Sc. পড়ে, কিন্তু শেষ করেনি, I.A.S ইত্যাদি পরীক্ষা দিতে থাকে| লিখিত পরীক্ষায় I.A.S. নির্বাচিত হলেও মৌখিকে ফেল করে, মনে হয়, প্রধানত গর গর করে ইংরেজি বলতে না পারায়| এই সময় W.B.C.S. উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি নেয়, 1956 সালে| মন্টুর পড়ার খরচ অনেকাংশে সেজদা বহন করেছে| আমি Applied Mathematics এ M.Sc. পড়ি, 1955-57. M.Sc.র ফল বেরোয় 1st February,1958. চাকরির সন্ধান সুরু করি| সেজদার পরামর্শ হল I.A.S. পরীক্ষার জন্য তৈরি হবার| কিছুদিন পড়শুনাও করি| ভাল লাগেনি| 1958 এর জুলাই মাসে Jadavpur Universityতে Mathematics এর Lecturer পদে নিযুক্ত হই| 1961 সালের July মাসে Study leave নিয়ে পশ্চিম জার্মানির আখেন(Aachen) সহরে যাই DVL Institute of Theoretical Gasdynamics এর Director Prof. Klaus Oswatitsch এর অধীনে গবেষণা করি ও 1965 র ফেব্রুয়ারি মাসে Dr.rer.nat. ডিগ্রি লাভ করি| আবার যাদবপুরে ফিরে আসি 1965 এর অগাস্ট মাসে| খুবই সৌভাগ্য, 1965 এর ডিসেম্বর মাসে, open selection এর মধ্যে দিয়ে আমি Reader পদে উন্নীত হই| 1979সালের 4th April I.I.T. Kharagpur এ open selection এর মাধ্যমে Mathematics এর Professor পদে যোগ দিই| Kharagpur থেকে retire করি July, 1996. অতঃপর এক বছর reemployed হই, 1997 এর June মাস পর্যন্ত| ঐ বছরই আমার বড় ছেলে সূর্য(সন্দীপ) U.S.A.র North Texas University তে Nano Chemistryতে Ph.D. করার জন্য রওনা দেয়| আমার ছোট ছেলে ধ্রুব(শুভদীপ) I.I.T. Kharagpur এ Mathematics
পাঁচ বছরের M.Sc. কোর্সে পড়ছিল| শেষ দুবছর ও ওখানে LLR Hall এ থাকে| ইতিমধ্যে 1994 সালে আমার মেয়ে চন্দ্রার বিয়ে হয়েছে অনির্বাণের সঙ্গে| চন্দ্রা IIT Kharagpur থেকে Mathematics এ M.Sc. পাস করে| অনির্বাণ Management এ Ph.D. করে এখন পুণেতে International School of Business and Mediaর ডিরেক্টর|
দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আমাদের জীবনে যে বিরাট বিপর্যয়ের আকারে দেখা দেয়, তার তাৎক্ষণিক ফল দুঃসহ কষ্টের আকারে দেখা দিলেও ক্রমে ক্রমে তা আর পীড়াদায়ক থাকল না, সঙ্গে নিয়ে এল অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্য| আমাদের মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের সহপাঠি বন্ধুদের অনেকেরই এমন সৌভাগ্য হয় নি| দুঃখ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে| মনে পড়ে বৈষ্ণব কবিতার লাইনঃ” সুখ দুখ দুটি ভাই, সুখের লাগিয়া যে করে পীরিতী দুখ তারি ঘর যাই|” তবে সুখ বা দুঃখ কোনটাই চরস্হায়ী হয় না|
—প্রদীপ নিয়োগী

Leave a comment